প্রতিনিধি ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ , ৪:১৯:৩০ প্রিন্ট সংস্করণ
চাল চুরির মামলা এবং দফায় দফায় তদন্ত হয়েছে। তদন্তে চাল আত্মসাতের সত্যতা মিলেছে। তবুও চাল পাচ্ছে না হতদরিদ্র ব্যাক্তিরা । এমনটা ঘটেছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার গোস্বামী দূর্গাপুর ইউনিয়নে। তদন্তে আসামী হয়েছেন পাঁচজন। তারা হলেন গোস্বামী দূর্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান দবির উদ্দিন বিশ্বাস, তার বিশ্বস্ত কর্মী চালের ডিলার মোঃ আলিউল আজিম ওরফে ছোট লাল্টু, অপর ডিলার ইউনিয়ন অওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হকের ভাই মিন্টু হোসেন, ইউপি সদস্য মাগুরা গ্রামের মারেফুল ইসলাম এবং ১ নং মাগুরা ওয়ার্ড সভাপতি সোহরাব হোসেন। আদালত তাদের প্রতি সমন ইস্যু করলেও গত ২৭ আগষ্ট তারা হাজির হন নি। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তাদের ডেকে পাঠিয়েছে আদালত। ইউপি চেয়ারম্যান দবির উদ্দিন বিশ্বাস উচ্চ আদালত থেকে জামিনের চেষ্টা কওে ব্যর্থ হয়েছেন বলে এলাকায় খবর রটেছে। তদন্ত প্রতেিবদন সুত্রে জানা গেছে, ইউনিয়নের অধিকাংশ কার্ডধারী ২০১৬ সালে ওএমএস চাল এক বা দুই কিস্তি পেয়েছেন। পরবর্তীতে তাদের চাল দেয়া হয়নি।
ডিলার আলিউল আজিম এর অধীনে কার্ডধারী ব্যক্তির সংখ্যা ৪০০ জন। তাদের মধ্যে শংকরদিয়া গ্রামের মর্নি উদ্দিনের পুত্র সিদ্দিক, আবেদ আলীর পুত্র রাশিদুল ওরফে হিটু, মৃত সৈয়দ আলীর পুত্র জোয়াদ এবং নাটানা গ্রামের মৃত মতলেবের পুত্র আব্দুল আলীম জানান, তারা ২০১৬ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর ও ৪ঠা অক্টোবর দুই কিস্তি ৩০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। ৩০ কেজি ১০ টাকা দরে ৩০০ টাকা করে দাম নেয়ার নিয়ম থাকলেও হয়েছে ৩২০ টাকা নিয়েছে। এরপর থেকে তারা আর চাল পাননি। ৪৩১ নম্বর কার্ডধারী শংকরদিয়া গ্রামের বনি আমিন মন্টুর স্ত্রী শহরজান বলেন, প্রথম বছরে দুই কিস্তি চাল দিয়েছিল। তিনি আর চাল পাননি। নতুন তালিকা হবে বলে তার কার্ড ছিনিয়ে নিয়েছে ডিলার আলিউল আজিম। নতুন তালিকায় তার নাম রয়েছে। কার্ড ফেরত বা চাল কোনটাই দেয়া হচ্ছে না তাকে। কেন এমন আচরন করছে জানতে চাইলে বলেন, আমার সঙ্গে ভাল বনিবনা নেই। বিপক্ষে ফেলে দিয়েছেন তিনি। একই গ্রামের আকবরের পুত্র ৬৭৬ নম্বর কার্ডধারী মোঃ ইজাল বলেন, দুই কিস্তির পর তিনি আর চাল পাচ্ছেন না । কার্ড ছিনিয়ে নিয়েছে চেয়ারম্যানের লোকজন। ৬৮০ নম্বর কার্ডধারী ইয়াসিনের পুত্র আজিজুল হকের একই অভিযোগ।
এমন অভিযোগ সৈয়দ মন্ডলের পুত্র ৫৬৬ নম্বর কার্ডধারী মোঃ ছমির উদ্দিন ও ৫৭১ নম্বর কার্ডধারী তমিজ উদ্দিনের, মৃত বাহার আলীর পুত্র ৫৬৯ নম্বর কার্ডধারী সাহেব আলীর । ঝড়– জোয়ার্দ্দারের পুত্র ৫৬৮ নম্বর কার্ডধারী মতিয়ার রহমান বলেন, প্রথমে দুইবার তিনি চাল পেয়েছেন। মাঝে দীর্ঘদিন চাল পাননি। চলতি বছর ঝামেলা শুরু হলে তাকে ডেকে একবার চাল দেয়া হয়েছে। ৫৭৪ নম্বর কার্ডধারী মোঃ রশিদ চাল পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে।
ডিলার মিন্টু হোসেন এর অধীনে কার্ড রয়েছে ৩০০টি। তার কার্ডধারী গোস্বামী দূর্গাপুর গ্রামের মৃত ইমান আলীর পুত্র লালন আলী জানান, ২০১৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এবং ৭ অক্টোবর দুই কিস্তি ৩০ কেজি চাল পেয়েছেন। উত্তর মাগুরা গ্রামের মৃত মনিরুজ্জামানের পুত্র তোফাজ্জেল হোসেন জানান, তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর ৩০ কেজি চাল পেয়েছেন। একই গ্রামের মৃত লিয়াকত আলীর স্ত্রী সাহারা বানু এবং দক্ষিন মাগুরা গ্রামের মৃত সাকের আলীর পুত্র আরব আলী জানান, তারা ২৯ সেপ্টেম্বর ও ৭ অক্টোবর দুই কিস্তি ৩০ কেজি করে চাল পেয়েছেন। তাদের আর কোন চাল দেয়া হয়নি। এসব বিষয়ে উভয় ডিলার বলেন, ২০১৬ সালে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচী চালু হওয়ার পরে ইউনিয়নে ৭০০ জনের কার্ড ইস্যু হয়। উক্ত তালিকায় কিছু অসাধু ইউপি সদস্য ও গন্যমান্য ব্যাক্তিবর্গ তাদের নিজ আত্মীয় স্বজন এবং আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে কার্ড তৈরী করে। এখানে ইউপি সদস্যরা চেয়ারম্যানের দবির উদ্দিনের অধীনে চলেন । গন্যমান্য দু’জন হলেন দবির উদ্দিনের কর্মী জুয়েলার্সের দোকানী মহাদেব কর্মকার এবং ইউনিয়ন সভাপতি সিরাজুল হকের ভাই হাফিজুর রহমান। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার খোদেজা খাতুন তা বাতিল করে ৮৭৩(১৫) স্বারকে পুনরায় সঠিকভাবে তালিকা প্রনয়নের জন্য চিঠি দেন। তালিকায় যাতে স্বচ্ছল, ভিজিডি সুবিধাপ্রাপ্ত, একই পরিবারের একাধিক ব্যাক্তি স্থান না পায় সেই মর্মে সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে নতুন তালিকা হলে কিছু কার্ডধারী বাদ পড়ে । তারা চাল পাননি বলে অভিযোগ করেছে। এরপরেও তালিকায় স্বচ্ছল, একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি এবং ইউপি চেয়ারম্যান দবির উদ্দিন ও সভাপতি সিরাজুল হকের লোকজন স্থান পেয়েছে। নাটানা গ্রামের মৃত আয়ুব আলীর স্ত্রী ৩২৬ নম্বর কার্ডধারী জরিনা খাতুন বিধবা ভাতা এবং ওএমএস এর চাল পাচ্ছেন। তার পুত্র ৩২৫ নম্বর কার্ডধারী আমিরুল ইসলাম ও ৩২৪ নম্বর কার্ডধারী শাহানারা খাতুন ওএমএস এর চাল পাচ্ছেন। আমিরুল ইসলাম সম্প্রতি করোনাকালীন নগদ অনুদান ২৫০০ টাকা পেয়েছেন। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান দবির উদ্দিনের কর্মী।
আবার মৃত ব্যক্তিদের জীবিত দেখিয়ে সরকার প্রদত্ত গরীব অসহায় ও দুস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে । উক্ত ইউনিয়নের একজন ডিলার মোঃ মিন্টু হোসেন এর বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। মিন্টু হোসেন গোস্বামী দূর্গাপুর গ্রামের মৃত আকবর হোসেন এর পুত্র। ইউনিয়ন অওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ সিরাজুল হকের ভাই তিনি। তার অধীনে ইউনিয়নে ৩০০ ওএমএস কার্ড রয়েছে। তিনি নিয়ম অনুযায়ী ৩০০ টাকা নিয়ে কার্ডধারী গরীব দুঃস্থ্য ব্যাক্তিদের মাঝে ৩০ কেজি চাল বিতরন করবেন। ২০১৬ সালে এই কার্ড তৈরী হয়। কার্ডধারী অধিকাংশ ব্যাক্তিকে তিনি দুই কিস্তি ৩০ কেজি করে ৬০ কেজি চাল দিয়ে পরবর্তীতে আর চাল দেননি। এমনকি কার্ডধারী মারা যাওয়ার পরেও তিনি তাদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল উত্তোলন করেছেন।
চাল আত্মসাতের অভিযোগ বিভিন্ন প্রচার মিডিয়াতে আসার পর কুষ্টিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত, ইবি থানা কুষ্টিয়াতে গত ১৯/৪/২০২০ ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৯০ (১) (সি) এখতয়িার বলে মামলা দায়ের হয় যার নং ক্রিমিনাল মিস কেস ০১/২০২০। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সেলিনা খাতুন গোস্বামী দূর্গাপুর ইউপি চেয়ারম্যান দবির উদ্দিন বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে চাল আত্মসাত তদন্তের আদেশ দেন । ই বি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর আরিফকে পরবর্তী ৩/৬/২০২০ তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন। আদেশ ই বি থানার ওসি মোঃ জাহাঙ্গীর আরিফ তদন্ত করে চাল আত্মসাতের সত্যতা পেয়েছেন। তিনি উল্খে করেছেন, গোস্বামী দূর্গাপুর ইউনয়িনের উত্তর মাগুরা গ্রামের ১৭৮ নং কার্ডধারী আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী ফরিদা বেগম এর নাম নতুন ও পুরাতন উভয় তালিকায় রয়েছে। ফরিদা বেগম জানান, ২০১৬ সালে কার্ড ইস্যু হওয়ার পর একবার ৩২০ টাকা দিয়ে ৩০ কেজি চাল পেয়েছেন। পরবর্তীতে তাকে আর চাল দেয়া হয়নি। ওয়ার্ড মেম্বর মারেফুল ইসলাম এবং আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি সোহরাব হোসেন এর নিকটে গেলে তারা বলেন কার্ড বাতিল হয়ে গেছে। তাকে আর চাল দেয়া হবে না।
এ বিষয়ে ডিলার মিন্টু হোসেন বলেন, ফরিদা বেগম এর চাল ১ নং ওয়ার্ডের মেম্বর মারেফুল ইসলাম এবং ওয়ার্ড সভাপতি সোহরাব হোসেন রেজিষ্টারে টিপসই দিয়ে নিয়মিত উত্তোলন করে আসছেন। পরবর্তীতে ফরিদা বেগম ১৫/৪/২০২০ মিন্টু হোসেন এর নিকট থেকে ৩২০ টাকা দিয়ে ৩০ কেজি চাল সংগ্রহ করলে এলাকার লোকজনের মাঝে জানাজানি ও ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় । শুধু ফরিদা বেগমই নন আরো অনেকের কার্ডধারী ব্যাক্তির দুই কিস্তি চাল পাওয়ার পরে আর চাল পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। ডিলার মিন্টু হোসেন এর ১০৩ নং কার্ডধারী গোস্বামী দূর্গাপুর গ্রামের রুহুল, একই গ্রামের ৬০ নং কার্ডধারী আজিজুল হক এবং ৬৩ নং কার্ডধারী শরীফুল ১৫২ নং কার্ডধারী উত্তর মাগুরার হামিদা খাতুন মৃত্যুবরন করেছেন। ১৫২ নং কার্ডধারী উত্তর মাগুরা গ্রামের হামিদা খাতুন, ২৯০ নং কার্ডধারী গাংদী গ্রামের রফিকুল, ২৮১ নং কার্ডধারী একই গ্রামের মনোয়ারা মৃত্যুবরন করেছেন। এসব কার্ডধারী মৃত্যুবরন করলেও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল হকের ভাই ডিলার মিন্টু হোসেন টিপসই দিয়ে তাদের চাল উত্তোলন করেছেন। মৃত ব্যক্তিদের তথ্য তিনি কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করেছেন। এছাড়া ৩০ কেজি চাল ৩০০ টাকা করে নেয়ার নিয়ম থাকলেও তিনি ২০ টাকা করে বেশি নিয়েছেন।
ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী দবির উদ্দিন বিশ্বাস কার্ডধারী ব্যক্তির মৃত্যুও বিষয়ে অবগত থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে মৃত ব্যক্তিদের নামের কার্ড পরিবর্তন করার জন্য কোন ব্যবস্থা নেননি। তিনি গরীব ও অসহায় ব্যক্তিদের নামে বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাতের কাজে সহযোগিতা করেছেন এমন তথ্য প্রমান পাওয়া গেছে। তিনি ডিলার মিন্টু হোসেনকে বেআইনীভাবে চাল উত্তোলনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান দবির উদ্দিন বিশ্বাস এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ইউপি মেম্বর এবং গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাদের লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের নাম দেয়ায় সমস্যা হয়েছিল। যার কারনে নতুন তালিকা করা হয়। নতুন তালিকার কিছু কার্ডধারী চাল পাচ্ছে না এবং মৃত ব্যক্তিদের চাল কিভাবে উত্তোলন হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং কয়েক দফা তদন্ত হয়েছে। আদালতে চলমান বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।