রংপুর

উলিপুরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

  প্রতিনিধি ২ অক্টোবর ২০২৫ , ৪:০৩:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

উলিপুরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত

কুড়িগ্রামের উলিপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা। ভোগান্তিতে পরেছেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসা না পেয়ে চলে যাচ্ছেন জেলা কিংবা বিভাগীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদ-নদী বেষ্টিত এ উপজেলায় প্রায় ৫ লাখ মানুষের বসবাস। এ সকল মানুষের চিকিৎসার জন্য একমাত্র ভরসা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অনুমোদিত চিকিৎসকের পদসংখ্যা ২৬ জনের থাকলেও বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৪জন চিকিৎসক। কর্মরত ডাক্তার কেউই বিশেষজ্ঞ না হওয়ায় এবং অপ্রতুল আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জানা যায়, উপজেলায় ১টি পৌরসভা ১৩টি ইউনিয়নের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার চিকিৎসা সেবা দিতে মাত্র চার জন চিকিৎসক নিয়োজিত। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সালে ৩৩ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি প্রতিষ্ঠার পর ২০১৮ সালে তা ৫০ শয্যায় উন্নতি করা হলেও চিকিৎসা সেবার মান বাড়েনি। এ অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জুনিয়র কনসালটেন্টের ৬ পদের বিপরীতে একজনও নেই, মেডিকেল অফিসার, সহকারী সার্জন ও ডেন্টাল সার্জনের ১৬ পদের বিপরীতে আছেন দুইজন। চিকিৎসকের ২৬ পদের ২২টিই শূন্য রয়েছে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ৪র্থশ্রেণিসহ বিভিন্ন ধরণের ২৭৭টি পদ থাকলেও ১০৪টিই শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২টি এক্স-রে মেশিনের ১টি অচল হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। ৫টি ইসিজি মেশিনের ৩টি অচল, ২টির মধ্যে সেমিঅটো বায়োমেট্রিক এনালজারের ১টি অচল, সেল কাউন্টার মেশিন নষ্ট হয়ে আছে দীর্ঘদিন থেকে। তাছাড়া সরবরহকৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করার কারণে ধীরে ধীরে ধুলাবালির আস্তরণ পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলো।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহির্বিভাগে প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ জন রোগী আসে চিকিৎসা নেয়ার জন্য। চিকিৎসক অভাবে চিকিৎসা না পেয়ে ফিতে যেতে হচ্ছে অসহায় রুগীদের। একদিকে চিকিৎসা না পেয়ে হতাশ সাধারণ মানুষ অন্যদিকে চিকিৎসক সংকটে চিকিৎসা দিতে না পেয়ে অসহায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমন দৃশ্য দেখা যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। 

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে শুরু করে ওষুধ প্রদানের কাউন্টার পর্যন্ত নারী-পুরুষ রুগীর ভীড়। তারা সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছেন টিকেট নিয়ে। তখনো দেখা মিলছেনা ডাক্তারের। সাধারণ মানুষ ছুটাছুটি করছেন হাসপাতালের উপরতলা নিচতলার বিভিন্ন রুমে। কোথাও দেখা মিলছেনা ডাক্তারের। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে অনেকে ফিরে চলে যাচ্ছেন আবার কেউ ডাক্তার আসার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। 

উপজেলার ধামশ্রেনি যাদুপোদ্দার এলাকা থেকে আসা হাবিবুর রহমান (৬৫) বলেন, সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালে ডাক্তারের অপেক্ষায় আছি কোথাও ডাক্তার পাচ্ছিনা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, উপরতলা নিচতলার এমন কোন রুমে ডাক্তার খুঁজে পেলামনা। ডাক্তার কি আসবেনা আমরা চিকিৎসা পাবনা বলে ক্ষেপে উঠেন। 

পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের কানিপাড়া গ্রামের শফিকুল (৪৫) বলেন, “কামলা দিয়ে খাং। আজ কামত না যায়া হাসপাতালে আসনু, এলাও ডাক্তার নাই। এহন বাড়ি যাং”। 

ধামশ্রেণি ইউনিয়নের হাফিজুর রহমান বলেন, তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ডাক্তার আসল। তিনি বিশেষজ্ঞ নন ( উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার) ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকলে কিভাবে আমরা ভালো চিকিৎসা পাই। 

বজরা ইউনিয়নের গর্ভবতী রোগী শিমু আক্তার (২৩) জানান, আমি সকাল ১০ টায় এসেছি। এখন ১২টা বাজে। মাত্র ডাক্তার এসেছে বলে অভিযোগ করেন। 

মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি থেতরাই ইউনিয়নের রাহেলা বেগম (৪৫)। তিনি জানান, পেটের অসুখ নিয়ে এখানে ভর্তি হয়েছেন একদিন আগে। চিকিৎসা চলছে ধীরগতিতে। সব ওষুধ এখানে পাওয়া যায় না। বেশিরভাগ ওষুধ বাহির থেকে কেনা লাগে। 

পুরুষ ওয়ার্ডের গুনাইগাছ ইউনিয়নের ক্যানসার আক্রান্ত ভবেশ চন্দ্র (৭২) বলেন, আমি ক্যানসারের রোগী। নিয়মিত বিরতি দিয়ে দিয়ে স্যালাইন সহ অন্যান্য ওষুধ পুশ করার জন্য ভর্তি হই। আমাকে ভাল সেবা দিচ্ছে সকলেই। 

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ মেহেরুল ইসলাম জানান, আমরা চিকিৎসক সংকট নিয়ে খুবই সমস্যায় আছি। ২৬ জন চিকিৎসক পদের বিপরীতে আছে ৪ জন। তারাও আবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নন। তাই রোগীদের প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পরতে হচ্ছে। গুরতর অসুস্থ রোগীদের নাম ঠিকানা লিখে রেফার করার অভিযোগ প্রসঙ্গে ডাঃ মেহেরুল বলেন, এছাড়া উপায় নাই। এখানে রাখলে তো বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। তিনি আরও জানান, আমাদের এখানে কনসালটেন্ট পদ আছে ৬ টি। দীর্ঘদিন ধরে এই ৬ টি পদ শূন্য পড়ে আছে। তাহলে আমরা রেফার করবো না তো কি করব। হাসপাতালের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের ক্লিনারের পদ ৫ টি। বর্তমানে কর্মরত আছেন ১ জন। ফলে হাসপাতালের সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ব্যহত হচ্ছে। তিনি আরও জানান, কখনো কখনো  রোগী ও রোগীর স্বজনদের অশোভন আচরণে ডাক্তার আসলেও অল্প সময়ের মধ্যে বদলি নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নার্সিং সুপারভাইজার পারুলা খাতুন বলেন, বর্তমান হাসপাতালে নার্সদের কোন সংকট নাই। নার্সের ৩৩ টি পদের প্রায় সবকটি পূরণ আছে। তারা সবাই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারপরও তাদের দ্বায়িত্ব অবহেলার অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ হারুন অর রশীদ জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকটে চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে। মাত্র ৪জন চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে শূন্য পদের বিপরীতে আমরা জেলা সিভিল সার্জন মহোদয়ের কাছে চাহিদা জমা দিয়েছি। সেখান থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন পাঠিয়ে দেয়া হবে মর্মে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। কবে নাগাদ শূন্য পদের চিকিৎসক আসতে পারে এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা জানান, সেটি বলা মুশকিল। তবে আমরা চেষ্টায় আছি।

এবিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ স্বপন কুমার বিশ্বাস সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, শুধু উলিপুর উপজেলা নয়। কুড়িগ্রাম জেলার সকল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক সংকট আছে। আমি চেষ্টা করছি সেগুলো পূরণ করার জন্য। ইতোমধ্যে আমি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিকিৎসক চেয়ে আবেদন করেছি। 

আরও খবর

Sponsered content