প্রতিনিধি ১৩ নভেম্বর ২০২৪ , ৫:৩২:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ
সাগরদীপ দুবলার চরের আলোরকোলে শত বছর ধরে উদযাপন হয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্যবাহী রাসোৎসব। প্রতিবছর নভেম্বর মাসের পূর্ণিমার তিথিতে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আলোরকোলে জাকজমকভাবে পালিত হয় এই উৎসব। তারই ধারাবাহিকতায় এবছর ১৪ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হচ্ছে তিন দিনের এই রাসোৎসব।
গত ১৭ অক্টোবর খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে আন্তঃবিভাগীয় এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো।
বঙ্গোপসাগরের তীরে দুর্গম ও জনবিচ্ছিন্ন দীপ দুবলার চরের আলোরকোলে রাস উৎসব কবে থেকে পালিত হয়ে আসছে এ নিয়ে রয়েছে নানা মত। তবে এর সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া না গেলেও ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারী হরিভজন নামে এক সাধু ১৯২৩ সালে সুন্দরবনের দুবলার আলোরকোলে প্রথম রাস পূর্ণিমার পুজা শুরু করেন। ২৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সাধু একা একা বনে অবস্থান করে পুজা উদযাপন করতেন।
দুই যুগেরও অধিককাল বনের ফলমূল খেয়ে জীবনধারণ করেন তিনি। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি। এর পর থেকে সনাতন ধর্মের লোকেরা প্রতিবছর রাস পূর্ণিমার পুজা পালনের জন্য ছুটে যায় দুর্গম বনে। সনতনীদের এই রাস পুজা ধীরে ধীরে রাস মেলায় পরিনত হয়।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সনাতন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বনবিভাগ ও রাসোৎসব উদযাপন কমিটির সহযোগিতায় প্রতিবছর এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এজন্য আলোরকোলে তৈরী করা হয় অস্থায়ী মন্দির। সেখানে গিয়ে মনোবাসনা পুরণের আশায় পুজা-আর্চনা করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। নিয়ে যান খাসি-মুরগিসহ মানতের নানা সামগ্রী।
এক সময় এই রাস মেলায় পূণ্যার্থী ও দেশি-বিদেশি দর্শনার্থী মিলে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হতো। কিন্তু এতো লোকের আনাগোনা ও বাদ্যবাজনায় সংরক্ষিত বনের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্নক বিরূপ প্রভাব দেখা দেয়। যেকারণে ২০২১ সাল থেকে রাস মেলার আয়োজন বন্ধ করে শুধুমাত্র রাস পুজা বা সনাতনীদের উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নেয় বনবিভাগ।
বনবিভাগ ও উদযাপন কমিটি সূত্রে জানা যায়, রাস উৎসবস্থল দুবলারচরে যাওয়ার জন্য সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পাঁচটি রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া পূণ্যার্থীদের নিরাপত্তা, হরিণ শিকারি ও অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিরোধে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বনরক্ষীদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকবে।
সূত্র জানায়, এক সময় রাসোৎসবকে কেন্দ্র করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পারশাপাশি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধর্মের লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হতো সংরক্ষিত বনের দুর্গম এই দীপে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ঘিরে সেখানে নানা বাদ্যবাজনা, সঙ্গীত ও মেলা বসতো। এতে বনের জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক বিরুপ প্রভাব দেখা দেয়। তাছাড়া পুণ্যার্থীর ছদ্মাবরণে শিকারীচক্র বনে প্রবেশ করে হরিণসহ বন্যপ্রাণি শিকারে মতে উঠতো। বিষয়টি নজরে আসার পরে ২০২১ সাল থেকে জীববৈচিত্র্য রক্ষার সার্থে মেলা ও উচ্চৈস্বরে বাদ্যবাজনা নিষিদ্ধ করে বনবিভাগ। মেলার আয়োজন বন্ধ হওয়ার পর থেকে দর্শনার্থীদের সমাগম কমে যাওয়ার পাশাপাশি বন অপরাধও কমে যায় অনেকাংশে।
রাসোৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি ও দুবলার ফিশারমেন গ্রুপের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও সাগরতীর দুবলার চরের আলোরকোলের অস্থায়ী মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের প্রতিমা স্থাপন করা হবে। ১৪ নভেম্বর শুরু হবে পুজা আর্চনা। ১৬ নভেম্বর ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাগরের প্রথম জোয়ারের নোনা জলে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই মিলন মেলা। উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্রগ্রাম, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা, খুলনা থেকে আগত সনাতনী পুণ্যার্থীসহ দেশ বিদেশের কয়েক হাজার দর্শনার্থী সমবেত হবে দুবলার আলোরকোলে। বনবিভাগের কঠোরতায় বন অপরাধ কমে গেছে বলে দাবি করে তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করীম জানান, দুবলারচরের রাস উৎসবে সনাতন ধর্মের লোকজন ছাড়া অন্য কাউকে যাওয়ার অনুমতিপত্র (পাস) দেওয়া হবেনা। ১৪ অক্টোবর সকাল থেকে রাস উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট স্টেশন অফিস থেকে পূণ্যার্থীদের অনুমতিপত্র দেওয়া হবে।
ডিএফও আরো জানান, পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তায় পুলিশ ও কোস্টগার্ড সদস্যরা নিয়োজিত থাকবে। রাস উৎসবে যাওয়ার ছলে কেউ যাতে অবৈধভাবে সুন্দরবনে অনুপ্রবেশ বা হরিণ ও বন্যপ্রাণি শিকার করতে না পারে, সে জন্য কঠোর নজরদারি করা হবে। এজন্য বনরক্ষীরা নিয়মিত টহল কার্যক্রম পরিচালনা করবে।