প্রতিনিধি ১৬ অক্টোবর ২০২৩ , ৪:৩৭:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
বিরামহীন হামলা চালিয়ে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে ইসরায়েল। দেশটির বিমান হামলায় গাজায় অন্তত ২ হাজার ৬৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৬০০ জন। ২০১৪ সালে গাজায় ৫১ দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী যত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল, এবার মাত্র আট দিনে মেরেছে তার চেয়ে বেশি। নিহত প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক শিশু এবং নারীও রয়েছেন।
এরই মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে গাজায় স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে হামলা চালানো হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে। গাজায় স্থল হামলা চালানোর সম্ভাবনার মধ্যে এ বিবৃতি দিয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। তবে এ হামলা কবে, কখন শুরু হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু উল্লেখ করা হয়নি বিবৃতিতে। বিবিসি জানায়, ইসরায়েল প্রতিনিয়ত রণহুঙ্কার ছাড়লেও বিলম্বিত হতে পারে তাদের স্থল অভিযান।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী গত শুক্রবারই উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের পর উত্তর গাজার হাজারো ফিলিস্তিনি ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। জাতিসংঘের ত্রাণ ও পূর্ত সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর যোগাযোগ পরিচালক জুলিয়েট তোমা বলেছেন, গাজায় সংঘাতের প্রথম সাত দিনে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
‘নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়’
ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সমর্থনকারী জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের হামলা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ‘নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়’ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেছেন, গত আট দিন ধরে গাজা উপত্যকায় এক ফোঁটা পানি, এক দানা গম, এক লিটার জ্বালানিও আসতে দেয়নি ইসরায়েল। অবশ্য ইসরায়েল গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে পানি ছেড়েছে বলে জানিয়েছেন গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান। এদিকে আরব লিগ এবং আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধানরা যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের পরিকল্পিত স্থল হামলা ‘নজিরবিহীন অনুপাতের গণহত্যার দিকে নিয়ে যেতে পারে।’
আইসক্রিমের ফ্রিজারে লাশ
ফিলিস্তিনের গাজায় হাসপাতালগুলোর মর্গে লাশ রাখার জায়গা নেই। ফলে বাধ্য হয়ে আইসক্রিমের ফ্রিজারে লাশ রাখতে দেখা গেছে। আলজাজিরা প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকার আল-আকসা মার্টার্স হাসপাতালটির ছোট মর্গে লাশ রাখার জায়গা নেই। তাই বিভিন্ন কারখানা থেকে খাবার ও আইসক্রিমের ফ্রিজার এনে তাতে মরদেহ রাখা হচ্ছে। বিপুল হতাহতের সংখ্যা এবং স্থানীয় কবরস্থানে জায়গার অভাবে গাজা শহরের একটি গণকবরে কয়েক ডজন ফিলিস্তিনিকে শায়িত করা হয়েছে বলে দেশটির বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে। ইসরায়েলের গোলাবর্ষণ এবং বিমান হামলায় গাজা উপত্যকার অন্তত ৫০টি পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
২৭৯ ইসরায়েলি সেনা নিহত
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে, গত সপ্তাহে দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ইহুদিবাদী দেশটির ২৭৯ জন সেনা মারা গেছে। এটি ইসরায়েলের জন্য একটি অবিশ্বাস্য সংখ্যা। দেশটিতে এখন পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার ৪০০ জন মারা গেছে বলে গতকাল জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয়। হামলার পর হামাস ১২৬ ইসরায়েলিকে জিম্মি করেছে। তবে প্রথমে ইসরায়েল বলেছিল, হামাসের হাতে বন্দির সংখ্যা ১৫০।
লেবানন থেকে হামলায় ইসরায়েলি নিহত
লেবানন থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে উত্তর ইসরায়েলে এক ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়েছে। দেশটির উত্তর সীমান্তে এটিই প্রথম ইসরায়েলি বেসামরিক হতাহতের ঘটনা। লেবাননের গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বলেছে, তারা শাতুলার ইসরায়েলি সম্প্রদায়ের ওপর গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। লেবাননে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস নিশ্চিত করেছে, আন্তঃসীমান্ত সহিংসতা বৃদ্ধির মধ্যে শনিবার ভোরে দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করার সময় তাদের তিন সদস্য নিহত হয়েছেন। হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরায়েলের আরেক মাথাব্যথা লেবাবন সীমান্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসের চেয়ে আরও বেশি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ এবং কট্টর ইসরায়েলবিরোধী। গতকাল ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, লেবাননের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর কোনো আগ্রহ নেই ইসরায়েলের। লেবাননের সংগঠন হিজবুল্লাহ যদি সংযত থাকে, তাহলে সীমান্ত পরিস্থিতি যেমন আছে তেমনই রাখবে ইসরায়েল। এদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গাজায় বিমান হামলায় বিল্লাল আল কেদরাকে হত্যা করেছে তারা। তিনি হামাসের নুখবা কমান্ডার। ইসরায়েলিরা বলছে, তিনি গত শনিবার দক্ষিণ ইসরায়েলের কিবুতজ নিরিমে ইসরায়েলিদের গণহত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। হামাস হত্যার দাবি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
ব্লিংকেনের কাছে সৌদি-মিসরের উদ্বেগ
ইসরায়েলি হামলায় বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সৌদি যুবরাজ ও মিসরের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সঙ্গে বৈঠকে তারা এ মত দেন। ব্লিংকেনের সঙ্গে বৈঠকে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, তাঁর দেশ বর্তমান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে এবং গাজার অবরোধ তুলে নিতে কঠোর পরিশ্রম করছে। ক্রাউন প্রিন্স বেসামরিক নাগরিকদের যে কোনো উপায়ে টার্গেট করা বা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে– এমন অবকাঠামো এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থকে ব্যাহত করাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এদিকে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে বলেছেন, হামাসের আক্রমণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আত্মরক্ষার বাইরে চলে গেছে এবং এটি সম্মিলিত শাস্তির সমান। কায়রোতে রোববার ব্লিংকেনের সঙ্গে একটি বৈঠকের সময় আল-সিসি আরও বলেন, চলমান সংঘাতে কোনো বেসামরিক লোককে লক্ষ্যবস্তু করাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।
দ্বিতীয় রণতরী পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইসরায়েলকে সহায়তার অংশ হিসেবে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে বিমানবাহী দ্বিতীয় রণতরী বহর পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। শনিবার মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এই ঘোষণা দিয়েছেন। অস্টিন বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড ঠেকানো বা হামাসের হামলার পর যুদ্ধ আরও প্রসারিত করার যে কোনো প্রচেষ্টা রুখতে যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিচ্ছে। চলমান সংঘাতের মধ্যে এক সপ্তাহে আগে ইসরায়েলের কাছাকাছি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড নামের রণতরী বহর মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। এখন এই রণতরীর সঙ্গে যোগ দেবে ইউএসএস আইজেনহাওয়ার যুদ্ধজাহাজ বহর।
ইরানের হুঁশিয়ারি
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, অধিকৃত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েল চলমান নৃশংস গণহত্যা না থামালে যে কোনো সময় আঞ্চলিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। শনিবার কাতারের রাজধানী দোহায় স্বাগতিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মাদ বিন আবদুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ইহুদিবাদী সরকার প্রতিদিন শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে যাবে, এটা সহ্য করা যায় না। এই হত্যাকাণ্ড এবং গাজার মানুষের ওপর আরোপিত অবরোধের সমাপ্তি ঘটাতে হবে।’
নেতানিয়াহু ও আব্বাসের সঙ্গে বাইডেনের ফোনালাপ
চলমান সংঘাত নিয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শনিবার পৃথক ফোনকলে দু’জনের সঙ্গে কথা বলেন বাইডেন। বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং একই সঙ্গে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তায় সবকিছু করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। হোয়াইট হাউস এক বিবৃতিতে এমনটি জানিয়েছে। মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে ফোনালাপে বাইডেন ইসরায়েলে হামাসের ‘বর্বর হামলা’র নিন্দা জানান এবং মানবিক সহযোগিতা কার্যক্রম পরিচালনায় মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
সূত্র : বিবিসি, এএফপি, আলজাজিরা ও সিএনএন।