প্রতিনিধি ১০ অক্টোবর ২০২১ , ৬:২৩:৩০ প্রিন্ট সংস্করণ
সাইফুল ইসলাম শুভ, গাজীপুর সদর প্রতিনিধি:
গ্রামীণ জনপদে কচুরিপানা যেন প্রকৃতির অপরূপ দান। অধিকাংশ নোংরা আবর্জনাময় পরিবেশেই কচুরিপানার সমাহার বেশি। যার ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠে খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, ছোট পুকুর জলাশয় কিংবা দীঘি। প্রকৃতির এই দানকে অনেকে বাড়তি ঝামেলাই মনে করেন। আবার এই ফুলে অনেকে আকৃষ্ট হয়ে প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করেন। অনেকে আবার শৈশবের খুনসুটির কথা মনে করে ভাবতে থাকেন।
বিকেলে বিলের ধারে কচুরিপানাকে একত্রিত করে একটার উপর কয়েকটা রেখে সাঁকো তৈরি করে এপার থেকে ওপারে যাওয়া এখনো অনেকের মনে পড়ে।গ্রামের স্কুলপড়–য়া ছেলেমেয়েরা স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারের ডোবার পানিতে ফুটে থাকা ফুল তুলে নিজেরা খেলা করত আর বাড়িতে থাকা ছোট ছোট ভাই-বোনদের হাতে দিয়ে তাদের মন জয় করত। সে দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না।
কিন্ত নদীতে যেটুকু পানি জমে আছে তাতে দেখা যাচ্ছে সবুজ পাতার বেষ্টনির মাঝে ফুটে আছে সাদার উপর হাল্কা বেগুনি রঙের কচুরিপানা ফুল। পড়ন্ত বিকেলে বিলের ধারের পাশের রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে এমনই ফুলের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। এতে আকৃষ্ট হচ্ছে ফুল প্রেমি মানুষগুলো। গ্রাম বাংলার খাল-বিল, ছোট নদীতে ফুটে নোংরা জলে স্বর্গীয় এই কচুরিপানা ফুল। নীলচে শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত হালকা বেগুনি রঙের মায়াবী এই ফুল হারানো শৈশবকে খুব কাছে টানে।
সকলের কাছে খুব পরিচিতি এক উদ্ভিদের নাম হচ্ছে কচুরিপানা। সূত্রে জানা যায়, ১৮ শ’ সালের শেষভাগে এক ব্রাজিলিয়ান পর্যটক কচুরিপানা আমাদের দেশে নিয়ে আসে। মিরসরাই উপজেলার গ্রামাঞ্চলে এটিকে অনেকে ‘ফেনা” বলেও থাকে। এটির আদি জন্মস্থান দক্ষিণ আমেরিকায় বলে জানা যায়।
এর সাতটি প্রজাতি রয়েছে এবং বহুবর্ষজীবী। এটি দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। কচুরিপানার বায়ুকুঠুরি থাকায় সহজেই তা পানিতে ভাসতে পারে এবং এর ফুল অনেককেই করে। কচুরিপানার মূল পানি পরিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে এবং এর ফুল বিভিন্ন পাখির বীজ বিস্তরণে সাহায্য করে। গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামে শালদহ নদীতে কোন কোন অংশে কচুরিপানা এখনো দেখা যায়। অনেক বাড়ির অনাবাদি পুকুর জুড়েও দেখা যায়।
দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায়, কচুরি ফুলের মতো এত চমৎকার ফুল খুব কম আছে। পরিমাণগত দিক দিয়েও এর মতো এত ব্যাপক বিস্তৃত ফুল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। কবিগুরুর ভাষায়- বলা হয়েছে ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া।’ সত্যিকার অর্থেই যেখানে-সেখানে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এক আগাছা উদ্ভিদ যার কিনা উপকারের চেয়েও অপকারী দিক কোনো অংশেই কম না, এমন এক অবহেলিত উদ্ভিদে এত নয়নাভিরাম, মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক ফুল যা প্রকৃতিপ্রেমীদের বিমুগ্ধ না করে পারে না।
কচুরিপানা দেখতে গাঢ় সবুজ হলেও এর ফুলগুলো সাদা পাপড়ির মধ্যে বেগুনি ছোপযুক্ত এবং মাঝখানে হলুদ ফোটা থাকে। সাদা এবং বেগুনি রঙের মিশেলে এক অন্যরকম আবহ তৈরি করে। সাদা পাপড়ির স্থলে কোথাও হালকা আকাশি পাপড়িও দেখতে পাওয়া যায়।
পুরোপুরি ফুল ফোটার আগে একে দেখতে অনেকটা নলাকার দেখায়। পাপড়িগুলোর মাঝখানে পুংকেশর দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ফুলে ছয়টি করে পাপড়ি দেখা যায়। এলাকাভিত্তিক অনেকে একে একেক নামে চিনে থাকে। প্রায় সারা বছরই কচুরি ফুল ফুটতে দেখা যায়। কচুরি ফুলের মুগ্ধতায় আমাদের মধ্যে প্রকৃতি প্রেম জাগ্রত হোক।
কচুরিপানার স্থানীয় নাম র্জামুনী। যারা এর ব্যবহার ও উপকারিতা জানেন তাদের কাছে এটি একটি সম্পদ। আবার যারা এর ব্যবহার পদ্ধতি আয়ত্ব করতে পারেনি তাদের কাছে এটি একটি আগাছা ও বিড়ম্বনার। তাই এই সম্পদটির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অনেক কৃষক উৎপাদন খরচ হ্রাস করতে পারবেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
কচুরিপানার বহুমাত্রিক ব্যবহার কচুরিপানাকে অনেকে ভাসমান সবজি চাষ, মাছের খাবার, জৈব সার, গবাদি পশুর খাবার, রাস্তার গর্ত ভরাট করা, পিচ ঢালাইয়ের নতুন রাস্তায় পানি দেয়ার ও পিচ মজবুত করার জন্য, সিমেন্টের খুটি মজবুত করা ও পানি ধরে রাখার জন্য, কচুরিপানার শিকড়ে বল তৈরি করে সেখানে বীজ অঙ্কুরোদগম করানো, গোল আলু মালচিং করা, ঢেউয়ের হাত থেকে বসত ভিটে রক্ষার কাজে কচুরিপানা ব্যবহার করেন।
বর্তমানে ভাসমান সবজি চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য সরকারিভাবে কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি এই কার্যক্রমে জনগোষ্ঠীকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করা হলে কচুরিপানার যথাযথ ব্যবহার আরো বেশি বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহার পদ্ধতিগুলোর বিস্তৃতির মাধ্যমেও কচুরিপানাকে সম্পদে পরিণত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কচুরিপানার ব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে জনগোষ্ঠী ব্যাপক ধারণা লাভ করলে কচুরিপানা আগাছার পরিবর্তে প্রাকৃতিক সম্পদ হয়ে উঠবে।