প্রতিনিধি ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৮:০৬:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ
গাজায় হামাসের হাতে বন্দি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছিলেন ইসরায়েলিরা। শনিবার গাজায় ছয় জিম্মির মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর এই বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট পালন করেছে। বিক্ষোভ দমনে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারও কঠোর হয়েছে। গাজায় যুদ্ধে লিপ্ত অবস্থায় দেশে এমন উত্তাল বিক্ষোভের মুখে আরও বেকায়দায় পড়েছেন নেতানিয়াহু। জিম্মি মুক্তি চুক্তির জন্য বাড়ছে চাপ, আবার কট্টরপন্থিরা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের হুমকি দিচ্ছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শনিবার গাজায় ছয় জিম্মির মরদেহ উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েলিরা ক্ষোভে ফুঁসছে। তাদের মৃত্যু কেন্দ্র করে পুরো ইসরায়েল এক মাহেন্দ্রক্ষণে পৌঁছেছে। প্রবল বিক্ষোভ ও শ্রমিক ধর্মঘটে সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনেকটাই অনিশ্চিত। গণতন্ত্রে জন বিক্ষোভের মুখে সরকার পতনের ঘটনা নতুন কিছু নয়। তবে নেতানিয়াহুকে রাজনীতিতে টিকে থাকা একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে সিএনএন।
আদালতকে ব্যবহার করে বিক্ষোভ-ধর্মঘট দমনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভার কট্টর জাতীয়তাবাদীরা। প্রাথমিকভাবে তাদের প্রচেষ্টা সফল বলেই মনে হচ্ছে। যদিও দেশের ভবিষ্যৎ এখনও অনিশ্চিত।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তথ্যমতে, এখনও ১০১ জন জিম্মি হামাসের কব্জায় রয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৫ জন ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জিম্মিদের মুক্ত করতে হামাসের সঙ্গে চুক্তি করতে নেতানিয়াহুর দোদ্যুল্যমানতায় দেশবাসীর ক্ষোভ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে, হামাস সবসময় তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল ছিল। হামাস নেতা ইয়াহইয়া সিনওয়ার নেতানিয়াহুর সব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে চলেছেন। তার সবচেয়ে কৌশলী পদক্ষেপের মধ্যে আছে, ইসরায়েলিদের জনমতকে ব্যবহার করে নেতানিয়াহুর ভিত্তি দুর্বল করে তোলা।
হামাসের হামলায় প্রায় ১২শ ইসরায়েলি নিহত ও ২৫০ জনকে গাজায় জিম্মি করে রাখার এক বছর পূর্তি হতে চলেছে ৭ অক্টোবর। এই সময়কে সামনে রেখে সিনওয়ার বেশ সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রবিবার গভীর রাতে তেল আবিবের ব্যস্ততম ৮ লেনের মহাসড়ক ‘আয়ালন’-এ বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সেই রাতে রাস্তার পাশের দেয়ালে এক যুবককে নীল স্প্রে ব্যবহার করে ‘জিম্মি নাকি বিপ্লব’ শব্দগুচ্ছ ফুটিয়ে তুলতে দেখা গেছে।
আন্দোলনে উপস্থিত দুই কমবয়সী মেয়ে জানান, তারা এর আগে কোনও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেননি। তবে জিম্মিদের মরদেহ উদ্ধারের পর বিবেকের তাড়নায় তারা আসতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে এত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদেও নেতানিয়াহু টলবেন কিনা, তা নিয়ে পুরো জাতিই দ্বিধাগ্রস্ত। প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করা প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টও সরকারের মধ্যে অন্তর্কোন্দল নিরসনের পক্ষপাতী।
ইসরায়েল এখন কয়েক দিকে লড়াই করছে। দক্ষিণে হামাস, উত্তরে হিজবুল্লাহ, পশ্চিম তীরে হামলা ও তেহরানে হামাস নেতাকে হত্যা করা নিয়ে ইরানের প্রতিশোধের হুমকি।
মন্ত্রিসভায় নেতানিয়াহুর একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। হামাসের প্রতি সামান্যতম নমনীয়তা দেখানো হলে মন্ত্রিসভার কয়েকজন পদত্যাগের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তারা পদত্যাগ করলে মন্ত্রিসভা ভেঙে যেতে পারে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুজন হলেন জাতীয়তাবাদী ও কট্টর ডানপন্থি নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতমার বেন গাভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচ।
সরকারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বুঝতে পেরে কট্টরপন্থিরা নিজেদের সুবিধামতো কিছু নীতি প্রণয়নে মনোযোগ দিয়েছে। যেমন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ। তাদের জন্য নেতানিয়াহুর ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া হবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার শামিল। সেজন্যই বিক্ষোভ-ধর্মঘট দমনে তারা সবচেয়ে সরব।
তবে আন্দোলনকারীদের শক্তহাতে দমনে আদালতের আদেশ আদায় করার চেষ্টা করছেন বেন গাভির। তার প্রচেষ্টা সফল হলে আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সরকারের চাপের মুখে শ্রমিক ইউনিয়নের ঐক্য কতটা বজায় থাকে, সেটিও দেশের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার কারণে রাজনৈতিক ক্ষতি সীমিত করতে রবিবার একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন নেতানিয়াহু। বার্তায় ছয় জিম্মির মৃত্যুর জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক দক্ষতা দিয়ে এর আগেও বড় আন্দোলনের মুখেও টিকে গেছেন নেতানিয়াহু। তিনি এবারও হাল ছাড়বেন না বলে অধিকাংশের ধারণা। তবে তিনি কতদিন এভাবে টিকে থাকতে পারেন, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
রবিবারের মতো সামনের দিনগুলোতেও জনগণের ক্ষোভ-হতাশার বিস্ফোরণ দেখা দিতে পারে।
নেতানিয়াহুকে কেবল তার চিরচেনা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে না। তাকে মরণ খেলায় চ্যালেঞ্জ করছে হামাস, যারা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে যেকোন পন্থা অবলম্বনে পিছপা হবে না।
জিম্মি মুক্তির সম্ভাবনা কমার সঙ্গে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনেকটাই প্রশ্নের সম্মুখীন।