প্রতিনিধি ২৯ অক্টোবর ২০২৪ , ৭:৩৩:২৭ প্রিন্ট সংস্করণ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের সুপারভাইজার পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতিবাদ করে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন একই পদের আরেকজন নিয়োগ প্রার্থী জাহানারা মুক্তা । তিনি ‘হল সুপারভাইজার’ পদে নিয়োগপ্রাপ্ত সোহেল রানার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে নিয়োগ বাতিলের আবেদন করেছেন । তবে অনুসন্ধানে জাহানারা মুক্তার অভিজ্ঞতা সনদেও জালিয়াতির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ৮ নভেম্বর হল সুপারভাইজার পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেখানে বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা শিক্ষা প্রশাসনে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এ পদের লিখিত পরীক্ষা এবং ফলাফল ২০২৩ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে ৭ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ৩১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ঢাকাস্থ গেস্ট হাউজে মৌখিক পরীক্ষার পর সোহেল রানাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তবে নিয়োগটি অবৈধ দাবি করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) চিঠি দেন নিয়োগপ্রার্থী জাহানারা মুক্তা। ইউজিসি হল সুপারভাইজার পদে নিয়োগ প্রাপ্ত সোহেল রানার অভিজ্ঞতার সনদ যাচাই করতে ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ তারিখে গুজিয়াম আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে পত্র পাঠায়। চিঠিতে সোহেল রানা যে কম্পিউটার অপারেটর-কাম-হিসাব রক্ষক (খন্ডকালীন) কাজের অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়েছেন, সেটি যাচাই করার জন্য বলা হয়। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে ইউজিসি জানায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুজিয়াম আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হতে বিভিন্ন সময় প্রেরিত তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী `হল সুপারভাইজার` পদে নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ। অভিজ্ঞতা সনদে উল্লিখিত মাদ্রাসার অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত খাত থেকে বেতন-ভাতাদি পেতেন সোহেল রানা। এমন খণ্ডকালীন কাজের অভিজ্ঞতার সনদের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত/স্থায়ী পদে নিয়োগ প্রদান নিয়েও প্রতিবেদনটিতে প্রশ্ন তুলেছে ইউজিসি। তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন সিন্ডিকেটে বিষয়টি উপস্থাপন করে সিদ্ধান্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে লিখিতভাবে অবহিত করতে বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনটিতে।
পরবর্তীতে ৭ অক্টোবর ২০২৪ সোহেল রানার নিয়োগ বাতিল চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর লিখিত আবেদন জমা দেন জাহানারা মুক্তা। উক্ত পদের জন্য নিজেকে উপযুক্ত মনে করেন তিনি।
এদিকে, জাহানারা মুক্তা নিজেও হল সুপারভাইজার পদে তার অভিজ্ঞতার প্রত্যয়নপত্র জালিয়াতি করেছে বলে অনুসন্ধানে জানাগেছে। তিনি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ধীতপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১০ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল হাদী স্বাক্ষরিত একটি অভিজ্ঞতার সনদ জমা দেন, যেখানে বলা হয় তিনি ১ এপ্রিল ২০১৮ থেকে ৩১ আগস্ট ২০২১ পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল হাদী ২০১৫ সালেই অবসর গ্রহণ করেছেন।
প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাদী বলেন, “আমি বিগত ৩১/১২/২০১৫ তারিখ ধীতপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করি। জাহানারা মুক্তা নামে একটি অভিজ্ঞতার প্রত্যয়নপত্র যা ১০/০৯/২০২১ তারিখ ইস্যু করা দেখলাম, তা মিথ্যা ও বানোয়াট। জাহানারা মুক্তা নামে কাউকে আমি চিনিনা। এই নামে কেউ আমার কাছে থেকে কোনো সনদ নেয়নি। আর আমি দায়িত্বে থাকাকালীন আমার স্কুলে এই নামে কেউ কাজও করেনি। আর অভিজ্ঞতার প্রত্যয়নপত্রে যে স্বাক্ষর দেখলাম সেই স্বাক্ষরও ভুয়া। এই স্বাক্ষর আমার না।”
বর্তমান প্রধান শিক্ষক মো. আবুল ফারুকও এ বিষয়ে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, “আমি ২৬ আগস্ট ২০১৭ সালে এই বিদ্যালয়ে জয়েন করছি। এরপরে এই নামে (জাহানারা মুক্তা) কেউ খণ্ডকালীন কর্মরত ছিল না। আমি থাকাকালীন সময়েও আমি কোনো প্রত্যয়নপত্র দেইনি। যেহেতু সে এখানে নেই, সেহেতু কোনো প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার প্রশ্নই উঠেনা।”
তবে জাহানারা মুক্তা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “আপনাদের যাচাই-বাছাই ভুল হচ্ছে। ওনারা এধরণের কথা বলার কথা না। আমি ধীতপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকেই নিয়েছি। ওনারা (শিক্ষকরা) ভুল বলছে। আমার অভিজ্ঞতার সনদ বৈধ।”
অন্যের নিয়োগ বাতিল করে ভুয়া প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে নিজের নিয়োগ দাবি করা প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, “ইতোমধ্যে একটি কমিটি ফর্ম হয়েছে। তাদের কাছে চিঠিও গেছে। অনিয়মের যতগুলো আবেদন যাবে এই কমিটি সেগুলো যাচাই-বাছাই করবে। তারা যাচাই করে রিপোর্ট করবে। পরবর্তীতে এগুলো সিন্ডিকেটে নিয়ে যাবো এবং সিন্ডিকেট এই বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত দিবে।”
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “এসব বিষয় আমি আসার আগে হয়েছে। কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কমিটি এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে।”