রংপুর

পুড়িয়ে দেয়া যুবক ছিলেন নামাজি, তদন্ত কমিটি-গ্রেফতার ৩

  প্রতিনিধি ৩১ অক্টোবর ২০২০ , ১২:০৫:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সন্তানের সঙ্গে নিহত শহিদুন্নবী জুয়েল

ভোরের দর্পণ অনলাইন:
লালমনিরহাটের পাটগ্রামে এক যুবককে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জেলা প্রশাসন ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে। রোববারের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে কমিটি। ঘটনার শুরুতে কে বা কারা কোরআন শরীফ অবমাননার গুজব ছড়িয়েছে তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে সিআইডি।

বৃহস্পতিবার (২৯ অক্টোবর) বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে আসরের জামায়াত শেষে মুসল্লিরা মসজিদ ছেড়ে বের হয়ে যান। পেছনে পড়া অল্প কিছু লোকজনের চিৎকারে মুসল্লিরা ফিরে আসেন মসজিদে। পরে বাজারের ব্যবসায়ী ও বাজরে আসা লোকজন জড়ো হয়। উপস্থিত জনতার মধ্যে শোরগোল ওঠে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, গোয়েন্দা সংস্থার লোক পরিচয়ে দুই জন ব্যক্তি মসজিদে বোমা ও জঙ্গি আছে বলে তল্লাসি করার সময় কোরআন শরীফ অবমাননা করেছে।

জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্য থেকে কয়েকজন এসময় দুইজনকে মারপিট শুরু করে। খবর পেয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হাফিজুল ইসলাম মসজিদে গিয়ে নানাভাবে মুসল্লিদের অনুরোধ করে ওই দুজনকে পাশের ইউপি কার্যালয়ে এনে একটি কক্ষে রাখেন। এদিকে আরো শত শত মানুষ জড়ো হতে থাকে।

খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজ নিশাদ পুলিশে খবর দেন। পুলিশ যেতে যেতে লোকারণ্য হয়ে পড়ে আশপাশের এলাকা। থানার ওসি সুমন কুমার মোহন্ত, ইউএনও কামরুন্নাহার, উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল কোন রকমে ইউপি কার্যালয়ের ভেতর ঢুকতে পারলেও অভিযুক্ত দুই ব্যক্তিকে নিয়ে বের হতে পারেনি। বাইরে লোকজন কোরআন অবমাননাকারী আখ্যা দিয়ে প্রকাশ্যে হত্যার জন্য ওই দুইজনকে তাদের হাতে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানায়। এক পর্যায়ে কলাপসিবল গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। পুরো দেড় ঘণ্টা ভাঙচুর ও তাণ্ডব চালায়। সংখ্যায় কম হওয়ায় পুলিশসহ ভেতরে থাকা লোকজন কুলিয়ে উঠতে পারেননি। সন্ধ্যার আগে আগে হাজার হাজার লোক আসে ইউপি কার্যালয়ে। এক পর্যায়ে বারান্দার একপাশের গ্রিল ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে দুজনের একজনকে ছিনিয়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে গলায় দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে ২শ মিটার দূরে নিয়ে যায়। রাস্তার ওপর ফেলে পিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।

পুলিশ অপরজনকে নিয়ে কৌশলে ইউপি কার্যালয়ের দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে একটি ব্যাংকে আশ্রয় নেয়। কিন্তু সেখানেও ব্যাপক হামলা ও ভাংচুর চালানো হয়।

বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান এবং মেম্বররা জানান, প্রথম দফায় আসা লোকজনকে শান্ত করে আনা সম্ভব হয়েছিলো। কিন্তু সন্ধ্যার পর একটি গ্রুপ যোগ দেয়। মূলত এরাই বেশি উশৃঙ্খলতা দেখায়।

পাটগ্রাম থানার ওসি বলেছেন, যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা প্রকাশ্যেই ঘটিয়েছে। তাদের সকলের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে আছে। ইন্ধন ও উস্কানিদাতা সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

টানা ৫/৬ ঘণ্টা ধরে এই বীভৎস তাণ্ডব চলার পর রাতে র‍্যাব, ৩ প্লাটুন বিজিবি ও রিজার্ভ পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

জানা গেছেন, নিহত ব্যক্তির নাম শহিদুন্নবী জুয়েল। বাড়ি রংপুরের শালবনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে পড়ালেখা শেষ করে রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে লাইব্রেরিয়ান হিসাবে চাকরি নিলেও বছরখানেক আগে বাধ্যতামূলকভাবে রিজাইন করানো হয়। ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক ও ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন বলে জানিয়েছেন পরিবার ও প্রতিবেশীরা। চাকরী না থাকাসহ নানা কারণে জুয়েল গত কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন বলে জানিয়েছে পরিবার। তবে বদ্ধউন্মাদ ছিলেন না।

সুলতান জোবায়ের আব্বাস নামে একজন দলিল লেখককে নিয়ে একটি মোটরসাইকেলে করে বৃহস্পতিবার জুয়েল পাটগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে ভারতীয় সীমান্ত এলাকার বুড়িমারী স্থলবন্দর লাগোয়া বাজারে ওই মসজিদটির অবস্থান।

ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ নেওয়াজ নিশাদ বলেন, কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা তাণ্ডব চললেও পর্যাপ্ত পুলিশ না থাকয় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।

মসজিদের খাদেম জোবেদ আলী বলেন, নামাজ শেষ হবার পর অপরিচিত দুই লোক এসে গোয়েন্দা পরিচয় দিয়ে আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, মসজিদে অস্ত্র আছে। আলমারির চাবি চাইলে ভয়ে চাবি দেই। তারা মসজিদে গিয়ে শেলফ, আলমারি তছনছ করে। এ সময় একটি তাকের ওপর রাখা কোরান শরীফের পাশে পা রেখে তারা অস্ত্র খোঁজে।

এলাকাবাসী জানান, খাদেম জোবেদ আলী কোরআন অবমাননার কথা অনেককেই বলেছেন। কিন্তু বাসেদ আলী নামে এক মুসল্লিকে তার মুখোমুখি করলে জোবেদ আলী কথা ঘোরান। এতে জোবেদের ওপর ক্ষেপে যান তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন জানান, আবুল হোসেন নামে এক ডেকোরেটর ব্যবসায়ী প্রথম দুই ব্যক্তির একজনকে মারতে মারতে মসজিদ থেকে বের করে আনেন। কিন্তু আবুল হোসেনকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসায় পাওয়া যায়নি। তবে তার স্ত্রী ও মেয়ে জানান, মসজিদের ভেতর গালি দেয়ায় আবুল হোসেন একজনকে মেরেছিলেন বলে বাসায় ফিরে জানিয়েছিলেনে।

জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টি এম এ মোমিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাকি দুই সদস্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম ও পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেগম কামরুন্নাহার। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করছেন। ১ নভেম্বর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেবে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম শুক্রবার পাটগ্রাম থানায় উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। সিআইডিসহ অন্যান্য সংস্থা ঘটনার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।

লালমনিরহাটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রবিউল ইসলাম শুক্রবার সাংবাদিকদের নিহত শহীদুন্নবীর এবং আহত সুলতান জোবায়েরের পরিচয় জানান। তাদের উভয়ের বাড়ি রংপুর। লালমনিরহাট আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন জোবায়ের।

এদিকে এই ঘটনায় আশরাফুল, আরিফ হোসেন বায়েজিদ ও শরীফ নামে তিন জনকে শুক্রবার গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

সিআইডির ক্রইমসিন সদস্যরা বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। সিআইডির সিনিয়র এএসপি আতাউর রহমান সময় সংবাদকে বলেন, মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে ঘটনাটি ঘটানো হয়েছে। গুজবের উৎস, অর্থাৎ প্রথম কে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঘটনার কোন পর্যায়ে কারা এবং কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছেন সেটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

আরও খবর

Sponsered content