চট্টগ্রাম

বাঁশখালী এসএস পাওয়ারে কয়লার অভাবে অন্ধকারের শঙ্কা চট্টগ্রাম জুড়ে

  প্রতিনিধি ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৬:৫৪:৫৯ প্রিন্ট সংস্করণ

বাঁশখালী এসএস পাওয়ারে কয়লার অভাবে অন্ধকারের শঙ্কা চট্টগ্রাম জুড়ে

ইসলামী ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতায় বাঁশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র্র বন্ধের উপক্রম হয়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি বন্ধ হয়ে গেলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে শঙ্কা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের। ইসলামী ব্যাংক পিএলসির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এই জটিলতা। শতভাগ মার্জিন দিয়ে খোলা ৮টি এলসির অর্থ আটকে রেখেছে ব্যাংকটি। যে কারণে কয়লা বোঝাই ৩টি জাহাজ বর্হিনোঙরে এলেও কয়লা ছাড় বন্ধ রেখেছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটির মজুদ কয়লা ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। কেন্দ্রটিতে পুরো মাত্রার উৎপাদনে ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা প্রয়োজন। মাত্র ৬০ হাজার মেট্রিক টন কয়লার মজুদ আছে। বহিনোঙরে অবস্থানরত জাহাজে ৫৪ হাজার ১৬৩ মেট্রিক টন কয়লা রয়েছে, এই কয়লা খালাস করতে প্রায় ৬ দিন সময় লাগবে।

সূত্র জানিয়েছে, এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে এলসি জটিলতা দূর করার জন্য ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এরপর গত বৃহস্পতিবার আটকে থাকা তিনটি এলসির মধ্যে একটির পেমেন্ট দেওয়া হয়।

এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের চিফ ফিন্যান্সিয়াল অফিসার (সিএফও) ইবাদত হোসাইন ভূঁইয়া বলেন, এসএস পাওয়ার-১ এর নামে ইসলামী ব্যাংকের কোন শাখায় ঋণ নেই। শুধু ইসলামী ব্যাংক নয়, বাংলাদেশের কোন ব্যাংকে কোন ঋণ নেই। যা ঋণ রয়েছে সবটাই বিদেশি ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংক গুলশান সার্কেল-১ ব্রাঞ্চে চলতি হিসাব রয়েছে। সেখানে এলসির বাইরে প্রায় ১৬৫ কোটি টাকার মতো আমানত রয়েছে। সেই হিসাব থেকেও অর্থ ছাড় না করায় চাইনিজ প্রকৌশলীদের বেতন দেওয়াসহ দৈনন্দিন কর্মকান্ড পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এই সমস্যা কিছুটা সমাধানের পথে আছে। আশা করছি দেশের সম্পদ রক্ষার্থে অন্তবর্তীকালীন সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে বাকি দুটি এলসির পেমেন্টও কয়েক দিনের মধ্যে করা হবে বলে জানিয়েছে ইসলামী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে গত ১১, ১৫ ও ২৪ আগস্ট তিনটি জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসে পৌঁছায়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ইসলামী ব্যাংকের এলসি পেমেন্ট না পাওয়ার কারণে ইন্দোনেশিয়ার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কয়লা খালাস বন্ধ রাখে।
১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশংকা করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। দেশের আলোচিত শিল্প গ্রুপ এস আলম ও চীনের সেফকো থ্রী এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি শুরু থেকে নানা ঘটনার জন্মদিলেও এ কেন্দ্র্র থেকে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ হওয়ার পর জনগণ আশার আলো দেখে।

বাঁশখালী ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ট্যান ঝেলিং বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবারের দরকার হয়। না হলে শরীর নষ্ট হয়ে যায়, মারা যায়। পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যাপারটাও একি। পাওয়ার প্ল্যান্ট চালানোর জন্য কয়লা দরকার। না হলে পাওয়ার প্ল্যান্ট শাটডাউন হয়ে যাবে। আমরা ন্যাশনাল গ্রীডে পাওয়ার সাপ্লাই দিয়ে থাকি যার বেশীরভাগ চট্টগ্রামকে দিয়ে বাকিগুলো ঢাকা তে যায়। আপনি যদি আমাদের অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করেন, তাহলে বলবো আমরা ক্ষুধার্ত এবং অখুশি। পাওয়ার প্ল্যান্ট সচল রাখতে কয়লার প্রয়োজন। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে ৮টি এলসি খোলা হলে তার মধ্যে ৫টি এলসির কয়লা খালাস করা হয় । এসব এলসির মধ্যে ৩টির অর্থছাড় করার নির্ধারিত সময় ছিল যথাক্রমে গত আগস্ট মাসের ৬, ১১ ও ২২ তারিখ। সেই অর্থও ছাড় করা হয়নি। আগের কয়লার বিল না পাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙরে আসা ৩টি জাহাজ ( ১ লাখ ৬৮ হাজার টন) থেকে কয়লা খালাস বন্ধ রেখেছে রফতানিকারকরা। তারা আগের বিল নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কয়লা ছাড় করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

সুত্র মতে, ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি পুরোমাত্রার উৎপাদন করলে দৈনিক ১২ হাজার মেট্রিক টন কয়লা প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে কয়লার মজুদ রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার মেট্রিক টন। সে হিসেবে মাত্র ৫ দিনের কয়লা মজুদ রয়েছে। বর্হিনোঙরে থাকা জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করতে না পারলে আগামী সপ্তাহেই বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি। বাঁশখালীর বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটিতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে জ্বালানি খরচ হয় প্রায় ৭.৫৬ টাকার মতো।
একই পরিমাণ বিদ্যুৎ ফার্নেস অয়েল দিয়ে সরবরাহ দিতে গেলে পড়বে প্রায় ১৮ টাকার মতো। ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র্রটি পুরোমাত্রায় উৎপাদন করলে মাসে প্রায় ৯৫ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ দিতে পারে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ কয়লার পরিবর্তে ফার্নেস অয়েল থেকে পেতে হলে সরকারকে বাড়তি ৯৫০ কোটি টাকা গুণতে হবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম এই শঙ্কার কথা স্বীকার করে বলেন, কোন কারণে ওই কেন্দ্র্রটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে লোডশেডিং আরও বেড়ে যাবে। তবে পরিস্থিতি আগের চেয়ে এখন অনেকটা স্বাভাবিক। ইন্দোনেশিয়ার সাপ্লাইয়ার বেনিফিসিয়ারি ব্যাংকের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকে বারবার তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোন রকম সাড়া না পেয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।

উল্লেখ্য ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি বাঁশখালীর ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টটি জাতীয় গ্রীডের ৪শ কেভি সঞ্চালন লাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর গত ২৪মে থেকে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবারাহ শুরু করে। দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ও চীনের সেপকো থ্রির মালিকাধীন ২০১৬ সালে বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এই বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও এসএস পাওয়ারের মধ্যে চুক্তি সই হয়। চুক্তিতে বলা হয়, ২৫ বছর ধরে পিডিবি এই কেন্দ্রে উৎপাদিত সব বিদ্যুৎ কিনবে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২.৫০৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ঋণের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১.৭৮২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ইকুইটির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৭২৪.৬৭৮ মিলিয়ন ইউএস ডলার, এস আলম গ্রুপের (৭০%) এবং চীনের সেপকো থ্রি (৩০%) এর একটি যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠত হয়েছে। যে প্রকল্প থেকে বর্তমানে জাতীয় গ্রীডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। কয়লা সংকট এবং ব্যাংকের অর্থ ছাড় না হলে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে দেশের আলোচিত ১৩২০ মেগাওয়ার্ট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প।

আরও খবর

Sponsered content