ঢাকা

বিআরটিসি টুংগিপাড়া বাস ডিপো : অনিয়ম ও ভূয়া ভাউচারে নজিরবিহীন লুটপাট, অভিযুক্তরাই পুরস্কৃত

  এস এম বাবুল ২৯ অক্টোবর ২০২৫ , ৮:৪৩:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ

বিআরটিসি টুংগিপাড়া বাস ডিপো : অনিয়ম ও ভূয়া ভাউচারে নজিরবিহীন লুটপাট, অভিযুক্তরাই পুরস্কৃত

রিপিয়ার ও নিম্নমানের পার্টস দিয়ে গাড়ি মেরামত করে ভাউচারে নতুন পার্টসের বিল করে লাখ লাখ টাকা লুুটপাট ও নিম্নমানের পার্টস দিয়ে জোড়াতালির মেরামতে ঘনঘন ব্রেক ডাউনে ট্রিপ লস হয়। ট্রিপ কমে যাওয়ায় রাজস্বে ব্যাপক ক্ষতির অভিযোগ উঠছে টুংগিপাড়া (গোপালগঞ্জ) বাস ডিপোর সাবেক ম্যানেজার এনামুল হক ও কারিগর প্রধান মনির হোসেনের বিরুদ্ধে। জোড়াতালির মেরামতে ঘনঘন ব্রেক ডাউনে ২৫ সালের এপ্রিলেই ট্রিপ লস হয় সাড়ে একত্রিশটি এবং রাজস্ব ক্ষতি হয় নয় লাখের ও বেশি। ম্যানেজার এনামুুল হক টুংগিপাড়া ডিপোতে থাকাকালীন এগার মাসে ট্রিপ লস থেকে রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ কোটি টাকার উপরে বলে জানা যায়।

গাড়ির ব্রেক ড্রাম পাতলা হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকার পরেও পুরানোটাকে রিপিয়ার করে লাগানো হয়। কিন্তু ভাউচারে দেখানো হয় নতুন ব্রেক ড্রাম। সম্প্রতি ৫৯৪৭ গাড়িতে রিপিয়ার ব্রেক ড্রাম লাগানোর কথা জানান এক কারিগর। নিজের পরিচয় গোপণ রাখার শর্তে এ কারিগর আরো বলেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে টুংগিপাড়া ডিপোর ৬০৪৪ গাড়ী গুলিস্থানের সিবিএস-২ তে বসা ছিল।

একটা গাড়ি ২ মাস বসা থাকলে কর্পোরেশনের রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ লাখ টাকার উপরে। যেখানে এ সকল গাড়ি থেকে রাজস্ব ইনকাম হওয়ার কথা সেখানে নিম্নমানের ২ নাম্বার পার্টস লাগানোর কারণে মাসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা কর্পোরেশনের রাজস্ব কম হয়। রিলিজ বেয়ারিং নষ্ট হলে নতুন না লাগিয়ে পুরানোটা রিপিয়ার করে লাগিয়ে ভাউচার করেন নতুন বেয়ারিংয়ের। ৬০২৪ গাড়ির গিয়ারবক্সে পুরানো রিলিজ বেয়ারিং লাগানোর কারণে রাস্তায় নষ্ট হওয়ার নজির আছে।

৫৬৭৫ নাম্বার গাড়ীটি কোরবানী ঈদের পর থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইঞ্জিনের কাজ ৩ বার করা হয়েছে। প্রতিবার মেরামতের পর টেকনিক্যাল প্রধানের নির্দেশে পোড়া মবিল দিয়ে স্টার্ট করায় ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্থ হয় যা পুনরায় আবারো বাঁধাতে হয়। অথচ একবার ইঞ্জিন বাধালে ৮ মাস থেকে ১ বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করার কথা থাকলেও দুই মাসে তিনবার ইঞ্জিন বাঁধাই করা হয়েছে। রিপিয়ারের মেরামতে পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে, ইঞ্জিনের হেড দুই থেকে তিনবার মেরামত করার পরও একই সমস্যা রয়ে গেছে। ৬০৪৪, ৫৫০৩, ৫৬৭৫, ৫৯৪৭ ও ৬০২৪ গাড়ি গুলোতে অন্তত তিন মাসের ভিতরে ৫ থেকে ৭ বার ইঞ্জিন মেরামত করা হয়েছে।
ওমেরা ও মবিল কোম্পানির ব্রান্ডের মোড়কে আনা হয় খোলা মবিল। যা গাড়িতে দেওয়ার পর গাড়ির ইঞ্জিন ওভারহিট হয়। ফলে

ইঞ্জিনে গ্যাস মারার পাশাপাশি যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। বারবার অভিযোগ দেওয়ার পরও একই মবিল ব্যবহার করান কারিগর প্রধান। এছাড়া একই গাড়ি বারবার মেরামত দেখানো হলেও আড়ালে ভাউচার হয় ভালো গাড়ির। এছাড়া নষ্ট গাড়ির জন্য কেনা যন্ত্রাংশ না লাগিয়েই ভাউচারে তা লুটপাট হয়।

ডিপোর গোপণ সুত্রে জানা যায়, যে সকল মালামাল মিজান মটরস থেকে ক্রয় করা হয় বাহিরে তার মূল্যে অনেক কম। মোটা অঙ্কের কমিশনে এখান থেকে মালামাল কেনা হয়। প্রতিমাসে মিজান মটরস থেকে যে মালামাল কেনা হতো তার মোট মূল্যের ৩০ ভাগ নিতেন ম্যানেজার এনামুল হক, টেকনিক্যাল প্রধান মনির হোসেন নিতেন ১০ ভাগ ও সহকারি ফোরম্যান জাহিদ হোসেন সজিব নিতেন ৫ ভাগ।

ম্যানেজারের দুর্নীতির অডিও রেকর্ড ডিপোর চালক রজো খাঁর মোবাইলে সংরক্ষণ থাকায় বাইরের সন্ত্রাসী দিয়ে তাকে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগে ম্যানেজার এনামুল হকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেন রজো খাঁর স্ত্রী হীরা খানম। ম্যানেজারের বিরুদ্ধে মামলা করার পর তিনি আর ডিপোতে যাননি। পরে তাকে ময়মনসিংহ বাস ডিপোতে বদলী করা হয়। তার এই বদলীতে বিষ্মিত পুরো বিআরটিসি। অনেকে এই বদলীকে প্রাইজ পোষ্টিং হিসেবেও দেখছেন। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নিয়োগ ও ইউনিট প্রধানের দায়িত্ব পুরো প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়েও অনেকের মাঝে কৌতুহল আছে। কথিত আছে, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে চাকুরি ও ইউনিট প্রধানের দায়িত্ব পেতে তিনি উর্দ্ধাতন কর্তৃপক্ষকে আর্থিক সন্তুষ্টিতে পদ ভাগিয়ে নিয়েছেন।

অভিযোগের বিষয়ে কারিগর প্রধান বলেন, গাড়ি বেশি পুরানো তাই ঘনঘন মেরামত করা লাগে। তবে পুরানো পার্টস লাগানোর কথা সত্য নয়। যেহেতু নতুন পার্টস পাচ্ছি সেহেতু পুরানো পার্টস কেন লাগাবো। ব্রেক ড্রাম কেটে লাগানোর কথা স্বীকার করলেও পোড়া বা খোলা মবিল ব্যবহারের কথা অস্বীকার করেন। মিস্ত্রি অসুস্থ থাকায় ৬০৪৪ গাড়িটি সিবিএস-২ তে কিছুদিন বসে ছিল। ৫৬৭৫ গাড়িটি দুই মাসে দুই বার ইঞ্জিন মেরামত করা হয়েছে। গাড়িতে যে পার্টস লাগানো হয় তা রেজিষ্টারে এন্টি করেই ভাউচারে দেখানো হয়।
ম্যানেজার এনামুল হকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি এমনকি হোয়াটসআপে ম্যাসেজ দিয়েও কোন জবাব পাওয়া যায়নি।

ম্যানেজার এনামুল হকের লুটপাট, ট্রিপ লস, রাজস্ব ক্ষতি ও ফৌজদারি মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও প্রাইজ পোষ্টিং নিয়ে কথা হয় পরিচালক (প্রশাসন ও অপারেশন) মো. রাহেনুল ইসলামের সাথে ভোরের দর্পণকে তিনি বলেন, পুরানো গাড়িতে সমস্যা কিছুটা থাকবে। ট্রিপ লস ও রাজস্ব ক্ষতি নিয়ে আরো কয়েকজন ম্যানেজারের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। প্রাইজ পোষ্টিং প্রসঙ্গে বলেন, চেয়ারম্যান মহোদয় নিজেই বদলি করেছেন সেহেতু এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।

প্রাইজ পোষ্টিং বিষয়ে জানতে বিআরটিসির চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লার মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া সম্ভব হয়নি।

আরও খবর

Sponsered content