প্রতিনিধি ১৪ আগস্ট ২০২৪ , ৭:৩০:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৩৮ বছরের পুরোনো আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যা ঘিরে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশ থেকে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার বিলোপের লক্ষ্যে বুধবার ভারতের স্বাধীনতা দিবসের রাতে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ পালনের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির নাগরিকরা। ‘‘মেয়েরা রাত দখল করো’’ নামের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি ভারতজুড়ে পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। ইতোমধ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে এই আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার মধ্যরাতে ভারতজুড়ে মেয়েদের রাত দখল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আর এই কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন যাদবপুরের এক তরুণী; তার নাম মঝিম সিং। তার একটা ডাক সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়; রাজধানী দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ব্যাঙ্গালুরু, হরিয়ানাসহ দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে ‘‘রাত দখলের কর্মসূচি’’ পালন করবেন বিক্ষোভকারীরা। দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক, ব্যাঙ্গালুরু শহরের টাউন হলের সামনে জমায়েতের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে।
কলকাতার যাদবপুরে রাত দখলের কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া রিমঝিম সিং বুধবার আনন্দবাজারকে বলেন, ‘‘ভাবতেই পারিনি এই আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে যাবে! এখন তো এত ফোন আসছে যে, আমার ফোনটাই হ্যাং হয়ে যাচ্ছে!’’
গত ১০ আগস্ট রাতে ফেসবুকে পোস্ট করে মেয়েদের রাত দখলের আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রেসিডেন্সির সাবেক শিক্ষার্থী রিমঝিম। তার কথায়, ‘‘যে কোনও ঘটনা ঘটলে কলকাতা তার একটা প্রতিবাদের বার্তা দেয়। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি বন্ধুবান্ধব, পরিচিতদের সঙ্গে কথা বলে ওই পোস্টটা করেছিলাম। ভেবেছিলাম পরিচিতরা আসবেন। প্রান্তিকলিঙ্গ যৌনতার কিছু মানুষ আসবেন। কিন্তু তা যে এই আকার নেবে, তা ধারণার মধ্যেও ছিল না।’’
সমাজবিদ্যার ছাত্রী ছিলেন রিমঝিম। এখন গবেষণা করছেন গৃহশ্রমিকদের নিয়ে। বাড়িতে অবসরপ্রাপ্ত বাবা এবং মা। মেয়ে যে ‘নেত্রী’ হয়ে উঠলেন, তা দেখে বাবা-মা কী বলছেন? হাসতে হাসতে রিমঝিম বললেন, ‘‘না-না, আমি নেত্রী নই। তবে হ্যাঁ, এত মানুষ সাড়া দিচ্ছেন দেখে বাবা-মা খুশি।’’ কলকাতার যে আবাসনে রিমঝিম থাকেন, সেখানকার বাসিন্দারা এসেও তাকে বলেছেন, ‘‘তুই দারুণ উদ্যোগ নিয়েছিস!’’
রিমঝিম প্রথম যে ডাক দিয়েছিলেন, তাতে যাদবপুর এইটবি বাস স্ট্যান্ডের সামনে জমায়েতের কথা বলা হয়েছিল। পরে তা বেড়ে হয় তিনটি এলাকা। যুক্ত হয় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বর এবং কলেজ স্ট্রিট। কিন্তু সেই তিন এখন ৩০০ পেরিয়ে গেছে। যদিও রিমঝিম বলছেন, বিভিন্ন জেলার ৬০-৭০টি জায়গা থেকে স্থানীয়রা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজেদের এলাকায় কর্মসূচি ঠিক করেছেন। তার ডাক দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতজুড়ে। এমনকি একটি জেলার এক একটি পৌরসভার একাধিক জায়গায় কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয়েরা। শুধুমাত্র স্বাধীনতা দিবসের রাতে মেয়েদের ওই কর্মসূচি ঘিরে তৈরি হয়েছে শত শত হোয়াট্স অ্যাপ গ্রুপ!
আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ ও নৃশংস খুনের ঘটনায় ভারতজুড়ে তোলপাড় চলছে। সেই প্রেক্ষাপটেই প্রতিবাদের ডাক দিয়েছিলেন রিমঝিম। তার কথায়, ‘‘যখন দেখলাম প্রিন্সিপালের বক্তব্য ছিল, কেন ওই নারী চিকিৎসক এত রাতে সেমিনার রুমে গিয়েছিলেন, তখনই ভাবলাম প্রতিবাদ করা উচিত। আমিও তো কত সময়ে পড়ে, কাজ সেরে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি।’’
কেন একজন কর্তব্যরত নারী চিকিৎসককে সেমিনার রুমে বিশ্রাম নিতে হবে, কেন সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো থাকবে না, সেই প্রশ্ন তুলে রিমঝিম বলেছেন, আসল বিষয়টি ‘লঘু’ হয়ে যাচ্ছে। তার কথায়, ‘‘নারীদের স্বাধীনতা নারীদেরই বুঝে নিতে হবে।’’
প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে সেভাবে সরাসরি ছাত্র সংগঠন করেননি রিমঝিম। তবে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে যখনই আন্দোলন হয়েছে, তিনি সঙ্গে থেকেছেন। তারই দুই বান্ধবী ‘মি-টু’ অভিযোগ এনেছিলেন। রিমঝিম লড়েছিলেন তাদের হয়ে। ২০১৮ সালে সাইবারাবাদে এক চিকিৎসককে খুন করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পরও যাদবপুর এইট বি-তে রাতে কর্মসূচি পালন করেছিলেন রিমঝিম ও সহপাঠীরা। সেটা ছিল নিতান্তই ‘প্রতীকী’। বেশি লোকও আসেননি। এবার আর তা ‘প্রতীকী’ নেই।
এদিকে, নারীদের রাত দখলের কর্মসূচিতে ‘বাম-রাম’ যোগ রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। রিমঝিম বলেন, ‘‘অনেকে তো বলছে আমি বিজেপির নেতাদের ফোন করে ডাকছি। বিশ্বাস করুন, সংসদীয় গণতন্ত্রে রয়েছে, এমন কোনও রাজনৈতিক দলের ওপর আমার আস্থা নেই। আমরা সিপিএমের শাসন জানি, আমরা তৃণমূলের জমানাও দেখছি। আমরা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর কথাও জানি।’’ তাহলে কেন এই রাজনৈতিক অভিযোগ?
রাত দখল আন্দোলনের আহ্বায়ক বলেন, ‘‘চলতি ব্যবস্থা যদি দেখে পাল্টা কোনও অভিমত শক্তিশালী হয়ে উঠছে, তখন তারা এটা বলবেই।’’ নারী স্বাধীনতা কী, পরিকাঠামো কী হওয়া উচিত, সে সব নিয়ে রিমঝিমের সুর্নিদিষ্ট বক্তব্য রয়েছে। সেই বক্তব্য শুনতে যদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও তাকে ডাকেন? সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ‘অনাস্থা’ থাকলেও রিমঝিম জানিয়েছেন, তিনি যাবেন।
রিমঝিম বলেন, মমতার রাজনীতির নানা সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত নন। যেমন নন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনীতির সঙ্গে। যেমন ছিলেন না সদ্যপ্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গেও।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসককে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এই ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে হাসপাতালের একজন স্বেচ্ছাসেবী কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাসহ ভারতজুড়ে হাজার হাজার নারী বুধবার মধ্যরাতে ‘‘রিক্লেইম দ্য নাইট’’ নামে পদযাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন। এই পদযাত্রায় হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ভয়াবহ এই ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে আন্দোলন শুরু করেছেন দেশটির নাগরিকরা। স্বাধীনভাবে এবং ভীতিহীন বেঁচে থাকার অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন তারা।