প্রতিনিধি ১৫ অক্টোবর ২০২৫ , ১২:২৯:৪২ প্রিন্ট সংস্করণ
ভারতে গত এক দশকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ২০২৩ সালে যেখানে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ছিল ৬৬৮, এক বছর পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৬৫টিতে—অর্থাৎ প্রায় ৭৪ শতাংশ বৃদ্ধি। এসব ঘটনার বেশিরভাগই ঘটেছে ক্ষমতাসীন বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে।
সম্প্রতি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোর বিভিন্ন এলাকায় “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোস্টার, টি-শার্ট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেয়ার কারণে বহু মুসলিম পুরুষকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কোথাও কোথাও তাদের বাড়িঘরও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, এই বাক্যটি “আইনশৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ।” অলাভজনক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) জানায়, এখন পর্যন্ত দুই হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মুসলিমের বিরুদ্ধে অন্তত ২২টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং ৪০ জনেরও বেশি গ্রেফতার হয়েছেন।
ঘটনার সূচনা
উত্তর প্রদেশের কানপুরে ৪ সেপ্টেম্বর ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা আলোকসজ্জিত বোর্ড লাগানো হয়। জনপ্রিয় “আই লাভ নিউইয়র্ক” লোগোর আদলে তৈরি এই বোর্ড ঘিরে স্থানীয় কিছু হিন্দু আপত্তি জানায়। তাদের অভিযোগ—উৎসবে নতুন উপাদান যোগ করা রাজ্য আইনে নিষিদ্ধ। পরে পুলিশ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তাদের বিরুদ্ধে “ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো”র অভিযোগ আনা হয়—যার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
এই ঘটনার প্রতিবাদে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা, পশ্চিমের গুজরাট ও মহারাষ্ট্র, উত্তরের উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মিরসহ একাধিক রাজ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় “আই লাভ মুহাম্মদ” লেখা পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায়।
এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর বেরিলিতে পুলিশি অভিযানে স্থানীয় ইমাম তৌকির রাজা ও তার সহযোগীসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং অভিযুক্তদের অন্তত চারটি বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়।
বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা
মানবাধিকারকর্মীরা জানাচ্ছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শত শত মুসলিমের বাড়িঘর একইভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে, প্রায়ই আদালতের নির্দেশ বা নোটিশ ছাড়াই। যদিও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, শাস্তি হিসেবে কারও বাড়ি ভাঙা অবৈধ এবং আগে নোটিশ দিতে হবে—কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয় না।
আইন ও সাংবিধানিক অধিকার
ভারতের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫ নাগরিকদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং অনুচ্ছেদ ১৯(১)(ক) মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। এসব আইন বলছে, যতক্ষণ না কেউ সরাসরি সহিংসতা বা বিদ্বেষ উসকে দেয়, ততক্ষণ তাদের ধর্মীয় প্রকাশ অপরাধ নয়।
এপিসিআরের জাতীয় সমন্বয়ক নাদিম খান বলেন, “কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় মামলা করছে, কারণ তারা জানে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ বলা কোনো অপরাধ নয়।” তিনি প্রশ্ন তোলেন, “দেশজুড়ে হিন্দু দেবতাদের ছবি কি মুসলিমদের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়? তাহলে কেন মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক অপরাধ হয়ে যায়?”
সমালোচকদের বক্তব্য
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে গণতান্ত্রিক মানদণ্ড ও সংখ্যালঘু অধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান আকার প্যাটেল বলেন, “‘আই লাভ মুহাম্মদ’-এর মতো শান্তিপূর্ণ বার্তার জন্য মানুষকে গ্রেফতার করা ভারতের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।” রাজনৈতিক বিশ্লেষক অসীম আলীর মতে, স্থানীয় ধর্মীয় বিরোধ এখন জাতীয় ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। “আইনের ব্যাখ্যা এমনভাবে দেয়া হচ্ছে, যেন মুসলিমদের যেকোনো ধর্মীয় প্রকাশই উসকানিমূলক অপরাধ।”
কানপুর ঘটনার পর মোদির নির্বাচনী এলাকা বারাণসীর বিজেপি নেতারা “আই লাভ বুলডোজার” লেখা পোস্টার লাগিয়ে এই অভিযানের প্রতি সমর্থন জানান—যা বিদ্বেষমূলক রাজনীতির ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হিসেবে সমালোচিত হচ্ছে।





