প্রতিনিধি ২৮ এপ্রিল ২০২০ , ৬:০৪:১৫ প্রিন্ট সংস্করণ
এমদাদুল হক, শ্রীপুর (গাজীপুর) : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার (আবদার) এলাকায় রাতে ঘরে ঢুকে মোবাইল চুরি করতে গিয়ে চিনে ফেলায় মা ও তিন সন্তানকে জবাই করে হত্যার ঘটনায় জড়িত যুবক পারভেজকে (২০) গ্রেপ্তার করেছে গাজীপুরের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
রোববার দিবাগত রাতে উপজেলার আবদার এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃত পারভেজ একই এলাকার কাজিম উদ্দিনের ছেলে। সে একাই চারটি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে। সোমবার রাত আটটায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছে গাজীপুর পিবিআইয়ের পরিদর্শক হাফিজুর রহমান।
গাজীপুর পিবিআইয়ের পরিদর্শক হাফিজুর রহমান জানান, পারভেজকে তার এলাকা থেকে আত্মগোপনে থাকাবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তার বসতঘর থেকে রক্তমাখা কাপড়, মাটির নিচ থেকে মোবাইল ফোন, পায়জামার পকেট থেকে তিনটি গলার চেইন, কানের দুল ও লুট করা স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। পারভেজ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করেছে। সংবাদ সম্মেলন করে চাঞ্চল্যকর বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে।
শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী জানান, ২৪ এপ্রিল শুক্রবার নিহত স্মৃতি ফাতেমার শ্বশুর আবুল হোসেন বাদী হয়ে শ্রীপুর থানায় অজ্ঞাতনামাদের অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। চার হত্যাকান্ডই পারভেজের অঘটন নয়। পারভেজের নামে এ ঘটনার আগে শিশু নিলিমাকে ধর্ষন ও হত্যার ঘটনায় শ্রীপুর থানায় একটি মামলা রয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আদালতে রয়েছে।
নীলিমার বাবা আবদার এলাকার হাসান ওরফে ফালান জানান, ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রæয়ারী তার কন্যা নীলিমাকে (৭) ধর্ষণ করে। পরে মাথায় লোহার রড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং শ্বাসরোধে মৃত্যু নিশ্চিত করে ওই পারভেজ। এ ঘটনায় পারভেজের বিরুদ্ধে থানায় মামলা ও পরে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়। পরে বয়স বিবেচনায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয় পারভেজ।
ফালান আরও জানান, জামিনে মুক্তির পর পারভেজ তার পরিবারের লোকদের নিয়ে কন্যা নীলিমা হত্যা মামলা প্রত্যাহারের জন্য এলাকাছাড়াসহ নানা ধরনের চাপ ও হুমকি দিতে থাকে। অন্যথায় সে তার সহযোগী ও পরিবারের লোকদের নিয়ে আমাকেসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও হত্যার হুমকি দেয়। এ বিষয়ে ২০১৮ সালে ২৮ আগস্ট নিরাপত্তা চেয়ে পারভেজসহ তার বাবা মা ও স্বজনদের অভিযুক্ত করে শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীতে হত্যাকান্ডের বর্ণনায় পারভেজ জানায়, ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার সময় কাজলের স্ত্রী ও বড় মেয়ের টাচ মোবাইল চুরির উদ্দেশ্যে পাশর্^বর্তী বাবুলের বাড়ির পিছনে যায়। সেখান দিয়ে কাজলের বাড়ির দেয়ালে বাইরে দিয়ে বের হওয়া ইট বেয়ে ছাদে উঠে। পরে নিজের কাছে থাকা বেøড দিয়ে ছাদে কাপড় শোকানো রশি কাটে। কাপড় ছাদের গ্রীলের সাথে বেঁধে রশি বেয়ে একটু নীচেই দোতলার বাথরুমের ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে ঢুকে। বাথরুমে থাকা ওয়াশিং মেশিনের উপর পা দিয়ে নিচে নামে। সে নুরা ও হাওয়ারিন এর রুমে প্রবেশ করে খাটের নীচে লুকিয়ে থাকে। তখন নুরার কানে হেডফোন ছিল ও ছোট বোন হাওয়ারিন ঘুমিয়ে ছিল।
আনুমানিক ১ ঘন্টা পর সকলে ঘুমিয়েছে ধারনা করে নীচ তলায় নেমে রান্না ঘরে প্রবেশ করে। রান্না ঘর থেকে ধারালো বটি নিয়ে মোবাইল নেয়ার জন্য দোতলায় উঠে। নুরার মা’র ঘরের দরজার লক খোলার শব্দে নুরার মা জেগে উঠে বাথরুমে ও আশপাশ কেউ আছে কিনা খোঁজ করে। নুরার মা (কাজলের স্ত্রী) স্মৃতি ফাতেমা তাকে দেখে চিনে ফেললে নুরার মা চিৎকার দেয়। তখন সে তার হাতে থাকা বটি দিয়ে কাজলের স্ত্রী স্মৃতি ফাতেমাকে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথারীভাবে কোপায়। নুরার মা অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।
নুরা শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলে তাকেও বটি দিয়ে মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। পরে নুরার ছোট ভাই ফাদিল জেগে উঠলে তার মাথায় কোপ মারে, সে ফ্লোরে পড়ে গেলে প্রথমে তাকে জবাই করে নুরার খাটের নীচে রাখে। তারপর হাওয়ারিন ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার দিলে তাকেও কোপায়। পরবর্তীতে সে নুরাকে ধর্ষন করে। নুরার মাকে ওড়না দিয়ে হাত পা বেঁধে অর্ধমৃত হাওয়ারিনকেও ধর্ষণ করে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে গলা কেটে হত্যা করে। এরপর নুরার মার গলায় ১টি স্বর্নের চেইন, ২টি কানের দুল ও ১টি কান ফুল ও ১টি নাক ফুল খুলে নেয়। হাওয়ারিন এর কান থেকেও ২টি স্বর্নের রিং খুলে নেয়। পরবর্তীতে আলমীরা খুলে ২টি স্বর্নের চেইন, ১টি আংটি, ১টি লাল রং এর ছোট ডাইরী, নুরার মায়ের রুম থেকে ২টি বড় টাচ মোবাইল নেয়। মোবাইল ও স্বর্নালংকার তার পরিহিত পায়জামার পকেটে রাখে। এরপর সে হাত মুখ ধুয়ে ফেলে পেছনের গেট খুলে নিজ বাড়ি চলে যায়।
গাজীপুর জেলা আদালতের ইন্সপেক্টর মীর রকিবুল হক জানান, সোমবার বিকেলে গ্রেফতারকৃতকে গাজীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হয়। পারভেজ ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দি প্রদান করে। পরে আদালত গ্রেফতারকৃত পারভেজের জামিন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন।
প্রসঙ্গত, ২৩ এপ্রিল গত বৃহস্পতিবার বিকেলে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আবদার এলাকার একটি বাড়ি থেকে মা স্মৃতি ফাতেমা, দুই মেয়ে ও এক ছেলের জবাই করা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২২ এপ্রিল বুধবার দিবাগত রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা চারজনকে গলা কেটে হত্যা করে। নিহতরা হলেন আবদার এলাকার প্রবাসী রেদোয়ান হোসেন কাজলের স্ত্রী ইন্দোনেশিয়ান নাগরিক স্মৃতি আক্তার ফাতেমা (৪৫), তার বড় মেয়ে সাবরিনা সুলতানা নূরা (১৬), ছোট মেয়ে হাওয়ারিন (১২) ও প্রতিবন্ধী ছেলে ফাদিল (৮)।