বাংলাদেশ

রাজশাহীতে বিএনপির গণসমাবেশ ‘ঠেকাতে’ মামলার হিড়িক

  প্রতিনিধি ২১ নভেম্বর ২০২২ , ৯:০৯:২৮ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক:

বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশকে ঘিরে জেলায় জেলায় চলছে মামলার হিড়িক। এসব মামলায় সরকাবিরোধী ‘গোপন বৈঠক’ কিংবা ‘নাশকতার চেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই বিভাগের আট জেলার মধ্যে এ পর্যন্ত ছয় জেলাতেই মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৫৬১ জন নেতাকর্মীকে। ২-১টি ছাড়া সব মামলার বাদীই পুলিশ।

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ের এটিই শেষ গণসমাবেশ। তবে গণসমাবেশের আগে জেলায় জেলায় বিএনপির নেতাকর্মীরা মামলার আসামি করা হচ্ছে।

জানা গেছে, এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজশাহীর বাগমারা, মোহনপুর, গোদাগাড়ী ও বাঘা থানায় বিএনপির ৭০০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সবগুলো মামলারই বাদী পুলিশ। এই মামলাগুলোতে বিএনপির স্থানীয় কয়েকজন নেতার নাম উল্লেখ থাকলেও বাকিদের অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

গত ১৭ নভেম্বর রাতে গোদাগাড়ী থানায় পুলিশ একটি মামলা করে। মামলায় গোদাগাড়ী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান বিপ্লবসহ (৪৯) পাঁচজনের নাম উল্লেখ আছে। মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা আরও প্রায় ২০০ জন।

পুলিশের এজাহারে বলা হয়, ১৬ নভেম্বর রাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা পৌর এলাকার সরমংলা হেলিপ্যাড এলাকায় গোপন বৈঠকে বসেন। সেখানে নাশকতার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। খবর পেয়ে থানা-পুলিশের একটি দল সেখানে গেলে আসামিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল মেরে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে চারটি ককটেল, বাঁশের লাঠি, ইট ও পাথর এবং বেশকিছু পানির বোতল উদ্ধার করে। গত ১৮ নভেম্বর বাগমারা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় ভবানীগঞ্জ পৌর বিএনপির আহ্বায়ক আখতারুজ্জামান বল্টুসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশের এজাহার অনুযায়ী, বাগমারার একটি স্কুল মাঠে রাতে নাশকতার পরিকল্পনা করতে বসেছিলেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পুলিশ সেখানে গেলে তারা পালিয়ে যান। পরে ঘটনাস্থল থেকে কিছু তাজা ককটেল ও লাঠিসোটা জব্দ করা হয়। এ নিয়ে মামলা করে পুলিশ।

এর আগে, গত ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর মোহনপুর থানায় একই আইনে একটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা আবদুস সামাদ, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক মাহবুব রহমানসহ সাতজন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া বিএনপির আরও অজ্ঞাত ১৫০-১৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, ১৫ নভেম্বর রাতে উপজেলার বসন্তকেদার এলাকায় গোপন বৈঠক করছিল বিএনপির নেতাকর্মীরা। পুলিশ গেলে তারা পালিয়ে যান। পরে সেখান থেকে চারটি অবিস্ফোরিত তাজা ককটেল, চাকু এবং কিছু ইট জব্দ করা হয়।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতিসহ ১৫০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহরিয়ার নাসিম বাদি হয়ে গত ১৯ নভেম্বর মামলাটি দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, বিএনপির নেতাকর্মীরা কেশবপুর স্কুল ও কলেজ মাঠে সংঘবদ্ধ হয়ে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা বোমা ও ককটেল ফুটিয়ে চলে যান। পরে ঘটনাস্থল থেকে অবিস্ফোরিত চারটি ককটেল ও ৬০-৭০টি বাঁশের লাঠি উদ্ধার করা হয়। শুধু রাজশাহীই নয়, এই বিভাগের আশেপাশের জেলাগুলোতে মামলা হয়েছে। বগুড়ার কাহালু উপজেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে গত ১৯ নভেম্বর ককটেল হামলা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে উপজেলা বিএনপির ৩৫০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

গত ২০ নভেম্বর কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছারোয়ার হোসেন কাজী মামলাটি দায়ের করেন। একইদিন নন্দীগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগে ১৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ওই দুই মামলায় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নন্দীগ্রাম উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শুভ আহম্মেদের অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপির কার্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ওপর ককটেল হামলা করা হয়। এ কারণে মামলা হয়েছে।’

তবে বগুড়া-৪ (কাহালু-নন্দীগ্রাম) আসনের বিএনপি-দলীয় সংসদ সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, ‘আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ সামনে রেখে পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করেছে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ যৌথভাবে দলীয় কার্যালয়ে হামলার ‘সাজানো নাটক’ মঞ্চস্থ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছে।’

এদিকে, নাটোরের লালপুরে বিএনপি অফিসের পাশে যুবলীগের নেতাকর্মীদের ওপর ককটেল হামলা ও পেট্রোল বোমা উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা হয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর রাতে লালপুর থানার এসআই হিমাদ্রী হাওলাদার ও স্থানীয় যুবলীগকর্মী শরীফ নেওয়াজ বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। উভয় মামলাতেই গোপালপুর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক নজরুল ইসলামসহ ২৫ নেতাকর্মী আসামি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিন্টু রহমান বলেন, ‘গত ২০ নভেম্বর ছাত্রদলের কর্মীসভা ছিল। ওই কর্মীসভায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে এমন খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে যায়। পরে পুলিশের বাধায় ছাত্রদলের কর্মীরা সভা ত্যাগ করার সময় একটি ককটেল বিস্ফোরিত হলে দুই কনস্টেবল আহত হয়। পুলিশ সভাস্থলের কাছ থেকে পাঁচটি ককটেল উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় মামলা ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৮০ জনের বিরুদ্ধে হয়েছে।

এ অভিযোগ অস্বীকার করে নাচোল উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব আবু তাহের খোকন পুলিশের বলেন, ‘ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জমায়েত হওয়ার আগেই পুলিশ বিনা উসকানিতে ধাওয়া করে সভা পণ্ড করে দিয়েছে। আর ককটলে উদ্ধার বা বিস্ফোরণের ঘটনাটি সম্পূর্ণ বানোয়াট।’

গত ১৮ নভেম্বর জয়পুরহাটে বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিস্ফোরক দ্রব্য মামলায় জেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতিসহ চার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

মামলার বাদী জয়পুরহাট সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) নূর আমীন বলেন, ‘শুক্রবার রাতে জয়পুরহাট শহরের শান্তিনগর মহল্লায় রাজিবের বাড়িতে ৩০-৩৫ জন ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাকর্মী নাশকতার পরিকল্পনায় গোপন সভা চলছিল। এসময় পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়ে ১০টি ককটেলসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে সাতজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২০-২৫ জনের নামে মামলা করা হয়।’

সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘গত ১৮ নভেম্বর শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চলছিল। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হামলা ও ককটেল নিক্ষেপ করে। তারা সাবেক এমপির গাড়ি ভাঙচুর ও তাকে আহত করেছে। পরে তারাই বিএনপির দুই শতাধিক নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়েছে।’

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন আলী হাসান বলেন, ‘বিএনপি নাশকতার উদ্দেশে দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল নিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায়। বিএনপি আবার দেশে নাশকতা শুরু করেছে।’

কামারখন্দ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরন্নবী প্রধান বলেন, ‘২৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ১৫০-২০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছে আওয়ামী লীগ।’

জেলায় জেলায় মামলার বিষয়ে বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুুস তালুকদার দুলু আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা রাজশাহীতে শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ করতে চাই। এ কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রস্তুতিমূলক সভা হচ্ছে। এ সভাগুলোকে নাশকতার চেষ্টা বা গোপন বৈঠক আখ্যা দিয়ে পুলিশ হয়রানিমূলক মামলা করছে। আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। যাতে গণসমাবেশ ফ্লপ হয়। কিন্তু এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে আরও জেদ তৈরি হয়েছে। হামলা, মামলা এমন কি পরিবহন ধর্মঘট হলেও সকল বাধা উপেক্ষা করে তারা আসবেন। রাজশাহীর গণসমাবেশে পাঁচ লোকের সমগম ঘটবে।’

আরও খবর

Sponsered content