ধর্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব ও মর্যাদা

  প্রতিনিধি ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৪:৩৯:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ

 

মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ:

আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যেসব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা কতো বড় নেয়ামত তা আমরা একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারবো, যদি আমরা বাকশক্তিহীন কোন মানুষের সামনে কিছু সময়ের জন্য বসি এবং তাকে পর্যবেক্ষন করি। সত্যই রব্বে কারিম মানুষকে ভাষার নেয়ামত যদি না দিতেন তাহলে মনুষ্য জাতি তার বাকশক্তির ব্যাবহার ও দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরনের ক্ষেত্রে মারাত্মক পর্যায়ের সংকটে পড়ে যেত। মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি নিজেই তাকে ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা শিখিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ”করুণাময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, সৃষ্টি করেছেন মানুষ তাকে শিখিয়েছেন বর্ণনা।” (সূরা আর রহমানঃ ১-৪)

পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ হাজার রকমের ভাষায় তাদের ভাব আদান প্রদান করে। অন্তর্জালের এক তথ্য অনুযায়ী বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় সাত হাজারের ও অধিক ভাষায় মানুষ কথা বলে। এবং প্রধান যে কয়টি ভাষা মানুষ বেশি ব্যাবহার করে তার সংখ্যা হচ্ছে তেইশটি। ভাষার বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা মহান আল্লাহর একটি অনন্যা নিদর্শন ও নেয়ামত। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বলেন- ”আর তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্নের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।” (সূরা রুমঃ ২২)

মাতৃভাষার গুরুত্বঃ প্রত্যেক মানুষের জন্য তার মাতৃভাষা আরো অনেক বড় নেয়ামত। যে ভাষায় সে কথা বলে, লিখে, সুখ-দুঃখের অনুভূতি প্রকাশ করে। আল্লাহ তা’আলা দ্বীন প্রচারের জন্য যে সকল নবী-রাসূলগনকে পাঠিয়েছেন প্রত্যেককে তার আপন জাতির ভাষা জ্ঞান দিয়ে পাঠিয়েছেন। যাতে করে তাঁরা তাদের উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে দাওয়াত পৌছাতে পারেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন-
”আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তার স্বজাতির ভাষা-ভাষী করে পাঠিয়েছি। তাদের নিকট পরিষ্কার ভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা ইবরাহীমঃ ৪)

প্রত্যেক মানুষের জন্য আপন আপন মাতৃভাষার বিশুদ্ধ চর্চা আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতার একটি অংশ। বিশেষভাবে উলামায়ে কেরামের জন্য বিশুদ্ধ মাতৃভাষা চর্চা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কারন আমরা সর্বপ্রথম যাদেরকে দাওয়াত দিবো, তারা সকলেই বাংলাভাষী। যদি আমরা বিশুদ্ধরুপে মাতৃভাষার চর্চা না করি তাহলে দাওয়াতের এই দায়িত্ব অপূর্ণ রয়ে যাবে। নবীজির মাতৃভাষা ছিল আরবি এবং তিনি ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। নবীজি বলেন- ”আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী, কোরায়েশ গোত্রে আমার জন্ম”। সুতরাং বিশুদ্ধরুপে মাতৃভাষার চর্চা করা এবং তা প্রয়োগ করা প্রত্যেক মুসলমান দায়ির উপর গুরু দায়িত্ব।

মাতৃভাষা হোক আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্তঃ ভাষা পরিবর্তনশীল। স্থান, কাল ও সময় ভেদে ভাষার মাঝে পরিবর্তন হয়। অনেক সময় একই ভাষা অঞ্চল ভেদে অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন আমাদের বাংলা ভাষার রুপ এক ধরনের। আবার অঞ্চল ভেদে এই ভাষার অনেক রুপ পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, ভাষা আঞ্চলিক হোক বা বইয়ের হোক প্রত্যেকটাই আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত।

প্রত্যেক মানুষ যে যে ভাষায় কথা বলে, ভাব আদান-প্রদান করে, তা দুই ধরনের। ১.জন্মগত ভাষা (আঞ্চলিক ভাষা), ২. বইয়ের ভাষা (মাতৃভাষা)।
জন্মগত আঞ্চলিক ভাষা, এটার কোন ব্যাকরণ-উচ্চারন শিখতে হয়না। আল্লাহ তা’আলা কুদরতীভাবে মায়ের কোলে তা শিখিয়ে দেন। যাদের জন্মগত ভাষা এবং বইয়ের ভাষা এক এটা তাদের জন্য বড় একটি নেয়ামত। আর যাদের আঞ্চলিক ভাষা এবং মাতৃভাষার মাঝে তারতম্য আছে তাদের জন্য ভাষার নিয়ম-কানুন শিখতে হয়, যদি বিশুদ্ধভাবে কথা বলার ইচ্ছা থাকে।

মাতৃভাষাকে বিদেশি শব্দের প্রভাবমুক্ত রাখা চাইঃ প্রত্যেক ভাষারই আলাদা স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। মাতৃভাষাকে আঞ্চলিকতার প্রভাবমুক্ত রাখা যেমন প্রয়োজন, তেমনিভাবে ভাষার বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য মাতৃভাষাকে অপ্রয়োজনীয় বিদেশি ভাষার ব্যাবহার থেকে মুক্ত রাখা আরো বেশি প্রয়োজন। আমাদের বাংলাভাষীদের সবচেয়ে বড় আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, এ ভাষার জন্য আমরা আন্দোলন করেছি, রক্ত দিয়েছি অথচ এখন দিব্যি আমরা এ ভাষার অপব্যাবহার করছি, অবমূল্যয়ন করছি।

আধুনিকতার নামে সামাজিক ও গনমাধ্যম সমূহে যেভাবে বাংলা ভাষায় অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি ব্যাবহার করা হচ্ছে এবং আমরা আমাদের নিত্য দিনের কথ্য ভাষায় যেভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যাবহার করছি, অথচ এ শব্দগুলোর সুন্দর বাংলাও আছে। এতে মাতৃভাষার অপমান তো হচ্ছেই বরং মাতৃভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় এ মানসিকতা হুমকি স্বরুপ। অনেকেই আছেন বাংলার সাথে উর্দু আরবীকেও গুলিয়ে ফেলেন। এটাও ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, যেসব বিদেশি ভাষার শব্দ বাংলার সাথে একেবারেই মিশ্রণ হয়ে গেছে, সেগুলো ব্যাবহারে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বিকল্প বাংলা শব্দ থাকা সত্তে¡ও অনর্থক বিন ভাষা প্রিতি এটা ঔপনিবেশিক দাসত্বের আলামত। আর বিনদেশি ভাষার দাসত্ব দূর করার জন্যেই ১৯৫২ সালের এদিনে রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বার।

তাদের সে শহিদি রক্তের শোনিত ধারা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এদেশে অসংখ্য অগণিত সংগ্রামী বীর তরুন সমাজ। মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল মাতৃভুমির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। দু-দুটি সংগ্রামেই এদেশের মানুষ অর্জন করেছে বিজয় আর সফলতা। তাই এ মাসে আমাদের কিছু কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার।

এ মাসের কর্মসূচী : এ মাসে আমাদের যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকারঃ

১/ আমাদের বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত করার চেষ্টা করা। আল্লাহর রহমতে ১৯৫২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মানুষ এই দিনকে উদযাপন করলেও কয়েক বছর ধরে একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ভাবে সারা বিশ্বে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি বড় অর্জন। কাজেই এই দিনে আমাদের শপথ হবে, আমাদের মায়ের ভাষাকে আমরা সমৃদ্ধ করবো। এ দিন আমরা বিভিন্ন জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের তত্ত্বকে এই ভাষায় আলোচনা করার মাধ্যমে এবং ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি করে এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট থাকবো।

২/এই ভাষা এই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষের কাছে যেন সুস্থ, অপসংস্কৃতির কুপ্রভাবমুক্ত এবং শিরকের প্রভাবমুক্ত হয় এ জন্য কাজ করতে থাকা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একুশের যে গৌরব আমাদের দান করেছেন তা যেন ইসলামের কল্যানে, এই অঞ্চলের, এই দেশের মানুষের কল্যানে আমরা ব্যাবহার করতে পারি সে তাওফীক তিনি আমাদের দান করুন।

খতীবঃ মেরাদিয়া কবরস্থান মাদরাসা মসজিদ
খিলগাঁও, ঢাকা।

Powered by