ধর্ম

“ঐতিহাসিক রজনী শবে মে’রাজ”

  প্রতিনিধি ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৬:৪২:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ

মুফতী আবুল কালাম আজাদ:

সর্ব প্রথমে মহান আল্লাহ পাকের দরবারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে, তিনি এখনও আমাদেরকে এই বিশ্ব মহামারী কোভিড-১৯/ অমিক্রন থেকে নিরাপদ ও সুস্থ রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! সুপ্রিয় পাঠক বর্তমান যে সময় আমরা অতিক্রম করতেছি সেটা চাঁদের হিসেবে রজব মাস আর এই মাসে মহান আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (স:) এর মাধ্যমে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছেন সেটাকে ইসলামের পরিভাষায় মেরাজ বলা হয়।

যে রাতে মেরাজ সংঘঠিত হয়েছিল সে রাতকে শবে মেরাজ বলা হয়। অর্থাৎ মহান আল্লাহ তায়ালা নবীজিকে এই রাতে মক্কা থেকে বাইতুল মাকদাস এ নিয়ে যান অতপর উর্দ্ধ জগতে নিয়ে যান। যে চলাচলের মধ্যে কোন ইঞ্জিন জাতীয় যানবাহন ছিলনা, বিমান, হেলিকপ্টার রকেট ছাড়াই তিনি সাত আসমান পেরিয়ে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমন করেছেন। তাও আবার মাত্র এক রাতের কিছু সময় এর মধ্যে। বিষয়টা কতটা আশ্চর্য জনক! সেই জন্যইতো মহান আল্লাহ তায়ালা যখন মেরাজের আলোচনা করেছেন তখন শুরুতেই এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যা আশ্চর্য জনক বিষয়কে বোঝায়।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, পবিত্রতা ঐ সত্তার যিনি তার প্রিয় বান্দাকে রাত্রি ভ্রমন করিয়েছেন মাসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত আর যেখানে রয়েছে তার চারপাশে বরকত ও আমার নিদর্শনাবলি, নিশ্চয় তিনি সর্ব দ্রষ্টা ও সর্ব শ্রোতা। (সূরা বনি ইসরাইল-১) এখানে আল্লাহ তায়ালা প্রথমেই বলেছেন সুবহান, আর এই শব্দটি তখনই বলা হয় যখন কোন আশ্চর্যজনক ঘটনা সংঘঠিত হয়। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা আলোচনার প্রাম্ভেই দুনিয়া বাসিকে সতর্ক করতেছেন যে আমি আল্লাহ এখন যে বিষয়টি আলোচনা করব তা খুবই অবাক করার কথা। সুতরাং এই রাতের ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বলে বিশ্বাস করতেই হবে কারণ এই রাতের কথা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন, এই মেরাজের মাধ্যমে নবীজীকে আল্লাহ তায়ালা অলৌকিক ঘটনাও দেখিয়েছেন।

*মেরাজের সংক্ষেপ কথা

নবুওয়াতের দশম বছর অর্থাৎ যে বছর নবীজীর চাচা আবু তালেব যিনি নবীজির সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় পাশে থাকতেন সেই চাচা আবু তালেবের ইন্তেকাল হয়। কিছু দিন পর হুজুর (স) এর সহধর্মিণী হযরত খাদিজা (রা) যিনি সব সময় নবীজীকে হাজার প্রতিকুলতার মাঝেও সান্তনা দিয়ে দ্বীনের কাজে সহযোগীতা করতেন তিনিও ইন্তেকাল করেন। এতটা শোকের মাঝে যখন হুজুর (স:) সময় পার করতেছিলেন তখন ২৬শে রজব দিবাগত রাতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় হাবিব হযরত মুহাম্মাদ (স:) কে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করার জন্য উর্দ্ধ জগতে নিয়ে যান। নবী (স:) ইরশাদ করেন, এক রাতে নবীজী (স:) উম্মে হানীর গৃহে শায়িত ছিলেন। পূর্ণনিদ্রায় তখনও তিনি ব্যাপৃত হননি। সাথে অন্য ফেরেশতাও ছিল। সেখান থেকে নবীজীকে নিয়ে হাতিমে কাবা (অর্থাৎ কাবা গৃহের পাশের অংশ) শুয়ে রাখলেন। হযরত জিবরাইল ও মিকাইল (আ:) রসুলুল্লাহকে নিয়ে যমযম কুপের পাশে নিয়ে শুয়ে দিলেন এবং বক্ষ বিদীর্ন করে ক্বলব মোবারক বের করে যমযমের পানি দ্বারা ধৌত করেন অতপর একটি স্বর্ণের তশতরি (ছোট প্লেট) আনা হয় যা ইমান এবং হেকমতে পরিপূর্ন ছিল। সেই ঈমান ও হেকমত পূর্ণ করে দিয়ে হযরত (স:) এর বক্ষ পূর্বের ন্যায় ঠিক করে দিলেন। অত:পর বোরাক নিয়ে আসা হল। আর বোরাক হল এক বেহেশতী বাহনের নাম। যা খচ্ছর অপেক্ষা ছোট এবং গাধা অপেক্ষা বড়। বোরাকের রং ছিল সাদা বর্ণের। গতিছিল বিদ্যুৎ গতিসম্পন্ন। যার এক একটি কদম পরে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। রসূলুল্লাহ (স:) বোরাকে আরোহন করলে সে চলা শুরু করে। জিবরাইল (আ:) বললেন, হে বোরাক! এ কেমন চলন তোমার। তোমার পৃষ্টে হুজুর (স:) অপেক্ষা আল্লাহর প্রিয় বান্দা আর কেউ কোন দিন উঠে আরোহন করেনি। এ কথা শ্রাবন মাত্র বোরাক ঘর্মশিক্ত হয়ে উঠল এবং হুজুর (স:) কে নিয়ে রওয়ানা হল। জিবরাইল ও মিকাইল (আ:) নবীজীর সঙ্গে ছিলেন।

রসুলুল্লাহ (স:) ইরশাদ করেন, পথিমধ্যে এমন এক প্রান্তর অতিক্রম করলাম যেখানে অসংখ্য খেজুর বৃক্ষরাজি দৃষ্টিগোচর হল। জিবরাইল (আ:) বললেন, এখানে অবতরণ পূর্বক দু’রাকাত নফল নামাজ আদায় করুন। নবীজী (স:) বলেন, আমি অবতরণ করে নামাজ পড়লাম। জিবরাইল (আ:) বললেন ইয়া রসুলুল্লাহ জানেন কী? আপনি কোথায় নামাজ আদায় করলেন? আমি বললাম, না তা আমার জানা নেই। জিবরাইল (আ:) বললেন এটা হলো ইয়াসরিব (আগামীর মদিনা শহর) যেখানে আপনি হিজরত করবেন। অত:পর পূনরায় যাত্রা শুরু হল। অপর এক স্থানে এসে জিবরাইল (আ:) আবার অবতরণ পূর্বক নফল নামাজ আদায় করতে বললেন। নবীজী (স:) বলেন, আমি নেমে নামাজ আদায় করলাম। জিবরাইল (আ:) বললেন এটা হল সীনা উপত্যাকা। এখানে ছিল একটি বৃক্ষের নিকটে হযরত মূসা (আ:) আল্লাহর সাথে কথা বলেছেন, আপনি সেই বৃক্ষের কাছেই নামায আদায় করেছেন। (অর্থাৎ এই জায়গা হল তুর পাহাড়) আবার আরেকটি প্রান্তর অতিক্রমকালে জিবরাইল (আ:) তথায় নামাজ পড়তে বললে আমি নেমে নামাজ আদায় করলাম, জিবরাইল (আ:) বললেন, এখানে শোয়ায়েব (আ:) এর বাসস্থান ছিল। আবার যাত্রা শুরু হল। আরেকটি স্থানে পৌঁছে জিবরাইল (আ:) বললেন নামাজ আদায় করুন। আমি নামাজ পড়লাম জিবরাইল (আ:) বললেন এটা বাইতুল লাহাম যেখানে হযরত ইসা (আ:) জন্মগ্রহণ করেন।

নবীজী (স:) আরো বলেন, আমরা যখন সামনে যাচ্ছিলাম এক বৃদ্ধ ও এক বৃদ্ধা আমাকে ডাকলেন, জিবরাইল (আ:) বললেন সামনে চলুন। কিছুদূর যাওয়ার পর একটি জামাত আমাকে সালাম দিলেন। জিবরাইল (আ:) তাদের উত্তর দিলেন এবং বললেন প্রথম যে বৃদ্ধ ডাক দিয়েছিল সে হল শয়তান, দ্বিতীয় যে বৃদ্ধা ডাক দিয়েছিল সে হল দুনিয়া, তৃতীয় যে জামাত সালাম করেছেন তারা হলেন ইব্রাহীম (আ:) মূসা (আ:) ইসা (আ:)। অতঃপর নবীজী বলেন, আমি পথিমধ্যে এমন কতক লোককে দেখলাম যাদের নাসিকা তামার তৈরী, তারা নিজেদের নখ দ্বারা স্বীয় বক্ষ ও অবয়ব খামচাচ্ছিল। আমি এর মর্ম হেতু জানতে চাইলে জিবরাইল (আ:) বললেন, এরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করতঃ অর্থাৎ গীবত এবং অপরের দোষ ত্রুটি অনুসন্ধান করত।

অত:পর নবীজী এক ব্যাক্তিকে নহরে সাঁতার কাটা অবস্থায় দেখলেন, নদীর তীরে থাকা একজন তাকে পাথর নিক্ষেপ করছেন। জিবরাইল (আ:) বললেন সে দুনিয়াতে সুদ খাইতো। অত:পর নবীজী এমন এক জাতির নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, যারা ক্ষেতে যেদিন বীজ বপণ করছিলেন, সেদিনই ফসল কর্তন করছেন, এবং ফসল কর্তনের সাথে সাথে ক্ষেতময় পূনরায় ফসলে ভরে উঠছে। কারণ জানতে চাইলে জিবরাইল (আ:) বললেন, এরা আল্লাহর পথে জিহাদকারী তাদের একটি পূন্য সাত পূন্যের রূপ নেয় এবং যা খরচ করে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় নেয়ামত দ্বারা তার পরিবর্তন সাধন করেন।

আরেক সম্প্রদায় লোকদের অতিক্রম কালে দেখলেন প্রস্তারাঘাতে তাদের মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে। অত:পর তাদের মাথা আগের মত হয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য নিরন্তর চালু ছিল। নবী করিম (স:) কারণ জানতে চাইলে জিবরাইল (আ:) বললেন ফরজ নামাজের ক্ষেত্রে এরা গড়িমসি করত।

অত:পর আরো কিছু লোককে দেখতে পেলেন, তাদের সামনে এক পাত্রে রান্না করা গোশত এবং অপর পাত্রে কাঁচা ও পঁচা গোশত রাখা ছিল। তারা রান্না গোশতের পরিবর্তে কাঁচা ও পঁচা গোশত ভক্ষণ করছিল। হুজুর (স:) জানতে চাইলেন যে তারা কারা? জিবরাইল (আ:) বললেন এরা আপনার উম্মতের মধ্যে ঐ সকল পুরুষ যারা বৈধ ও সতী-স্বীয় পত্নী রেখে অপর নারীর সাথে রাত্রি যাপন করত। আর যারা এদের মধ্যে মহিলা তারা আপনার উম্মতের ঐ সকল রমনী যারা পবিত্র স্বামীকে ছেড়ে ব্যাভিচারী পুরুষের সাথে রাত কাটাত। নবীজী এক খন্ডের নিকট দিয়ে গমন করছিলেন। সেটি পড়েছিল পথের ধারে। তাকে অতিক্রম করার সময় কাঠটি যে কোন কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। নবীজী এই কাষ্ঠখন্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে জিবরাইল (আ:) বলেন যারা পথের ধারে বসে দস্যূবৃত্তি করত।

অত:পর কিছু লোককে দেখলেন যে তাদের জিহ্বা ও ঠোট কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। কাটা শেষ হলে আবার তা আগের মত হয়ে যায়। এভাবে এই কাজ অব্যাহত ছিল। তাদের পরিচয় জানতে চাইলে জিবরাইল (আ:) বললেন এরা ঐ সব বক্তা যারা অপরকে আমল করতে বলত অথচ নিজেরা আমল করত না। এক স্থানে সুশীতল হাওয়া বইছিল জিবরাইল (আ:) বললেন এটা বেহেশতের শীতল হাওয়া।

অত:পর, বাইতুল মোকাদ্দাসে অবতরণ করে বোরাক একটি কড়ার সঙ্গে বাঁধলেন যে কড়ায় আম্বিয়ায়ে কেরামগণ স্বীয় বাহন বেঁধে রাখতেন। অত:পর মসজিদে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে আকসায় অনেক লোকের সমাগম ঘটল। মোয়াজ্জিন আযান শেষে ইকামত দিতে লাগল। রসুলুল্লাহ (স:) বললেন আমরা কাতার বেঁধে দাড়িয়ে ইমামের অপেক্ষা করছিলাম, জিবরাইল (আ:) আমার হাত ধরে সামনে এগিয়ে দিলেন। আমি সেই জামাতে ইমামতি করলাম। নামাজ শেষে জিবরাইল (আ:) বললেন আপনি যাদের ইমামতি করলেন তারা প্রেরিত সমস্ত পয়গম্বরগণ ছিলেন। এভাবে আমাদের নবীজীর সম্মান ও মর্যাদা সকল নবীর উর্দ্ধে দান করেছেন এই মে’রাজের রাত্রে। অতঃপর নবীজীর সামনে তিনটি পেয়ালা রাখা হয়। একটিতে ছিল পানি দ্বিতীয়টিতে দুধ তৃতীয়টিতে ছিল মদ, রসূলুল্লাহ (স:) দুধের পেয়ালা পছন্দ করলেন। জিবরাইল (আঃ) বললেন, আপনি যদি মদের পেয়ালা নিতেন তবে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত। আর যদি পানি নিতেন তবে আপনার উন্নত ডেবে যেত। অতঃপর নবীজি (স:) সেখান থেকে সপ্ত আসমান অতিক্রম করে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমন করে ভোর হওয়ার পূর্বেই মক্কায় ফিরে আসেন। সুবহানআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা কত বড় মহান যিনি এত অল্প সময়ে কত দূরের পথ ভ্রমন করালেন আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন; আমিন!

ইসলামি লেখক

Powered by