উপ-সম্পাদকীয়

করোনা থেকে দূরে থাকুন

  প্রতিনিধি ৩০ মার্চ ২০২০ , ২:০৪:৩৮ প্রিন্ট সংস্করণ

সঞ্চিতা তানভির: মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাÑ পেশায় চিকিৎসক এই ভদ্র মহিলাকে চেনেন না এমন ব্যক্তি এই মুহূর্তে হয়তো বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ দেশবাসী যে বিষয়টি নিয়ে এখন খুবই আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেনÑসেই করোনাভাইরাস এবং তার সংক্রমণ সংক্রান্ত সব তথ্য তিনি আমাদের ধারাবাহিকভাবে জানাচ্ছেন। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পরিচালক হিসেবে কর্মরত ডা. ফ্লোরা প্রতিদিনই করোনাভাইরাস নিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন। দেশের মানুষের আগ্রহের কথা বিবেচনায় রেখে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও তাঁর সেই ব্রিফিং লাইভ করছে।
সর্বশেষ তথ্য জানান গত ২৪ মার্চ ‘দৈনিক করতোয়া’র এক প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানলাম নিজেদের সুরক্ষা ব্যবস্থা (পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট- পিপিই) না থাকায় বগুড়ায় সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আড়াই হাজার ডাক্তার-নার্স-কর্মচারীর জন্য পিপিই আছে মাত্র ২৭০টি। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকজন চিকিৎসক নিজেদের হতাশার কথা জানিয়ে ‘দৈনিক করতোয়া’কে বলেছেন তারা করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে রাজি আছেন কিন্তু যুদ্ধ করার জন্য তাদেরকে যথাযথ প্রস্তুত হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ তাদেরকে প্রয়োজনীয় পিপিই সরবরাহ করতে হবে। আমার মনে হয় চিকিৎসকরা অযৌক্তিক কিছু বলেন নি। অস্ত্র ছাড়া যেমন যুদ্ধ হয় না তেমনি নিজেদের সুরক্ষা করতে না পারলে চিকিৎসক-নার্সসহ তাদের সহকারীরা অন্যদের সুরক্ষা দিবেন কিভাবে?
যদিও বগুড়ায় এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোন রোগির সন্ধান পাওয়া যায়নি কিন্তু তারপরেও এ জেলারই গা ঘেঁষে থাকা গাইবান্ধায় দু’জনের সংক্রমিত হওয়ার খবরটি খানিকটা হলেও আমাদের শঙ্কার মধ্যে ফেলেছে। কারণ এতদিন বলা হচ্ছিল যে, বাংলাদেশে যারা করোনাভাইরাসে আক্রন্ত হয়েছেন তারা নিজেরা বিদেশ ফেরত; নয়তো বিদেশ ফেরত কারও সংস্পর্শে এসেছিলেন। কিন্তু গত শনিবার ঢাকার মিরপুরে ৭৩ বছর বয়সী যে ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন হিস্ট্রি ছিল না। এমনকি মৃত সেই ব্যক্তির ছেলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সেটি নিশ্চিত করেছেন। আর সে কারণেই তাঁর মৃত্যুর পর থেকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটির ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ কথাটি খুব আলোচিত হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে প্রচুর। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। এনিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও তারা জানিয়েছেন।
প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে বলেছেন, সমগ্র বিশ্ব আজ এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে চলছে। তবে যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের সরকার প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, এ সংকটময় সময়ে আমাদের সহনশীল এবং সংবেদনশীল হতে হবে। প্রধান মন্ত্রী তার ভাষণে দেশবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন।
তবে বিদেশ ফেরত কারও সংস্পর্শে না এসেও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ঢাকার মিরপুরে সেই বৃদ্ধের মৃত্যু দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর সেকারণেই তার মৃতুর পর পরই দেশজুড়ে লকডাউনের দাবিটি জোরালো হতে শুরু করে। এ নিয়ে ফেসবুকে প্রচুর লেখালেখিও হতে থাকে। আর জনগণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও বসে থাকেনি। দেশে গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে সরকার-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে ১০ দিনের ছুটি।
একে একে নানা পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। প্রথমেই ঘোষণা এল ২৫ মার্চ থেকে দেশের সব বিপণী বিতান বন্ধ থাকবে। এরপর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সরকারি- বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হলো। এছাড়া বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ২৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম দশ দিনের ওই ছুটি ঘোষণার কথা জানিয়ে বলেছেন, কেবলমাত্র কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান এবং হাসপাতালসহ জরুরি সেবাগুলো ছুটির আওতার বাইরে থাকবে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি ওই দশদিন জরুরি প্রয়োজন (খাদ্যদ্রব্য এবং ওষুধ কেনা, চিকিৎসা সেবা গ্রহণ এবং লাশের সৎকার) ছাড়া কেউ যাতে বাড়ির বাইরে না যান সে অনুরোধও জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা সরকারের এসব পদক্ষেপকে এক ধরনের ‘লকডাউন’ পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ করনোভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এর কোন বিকল্প নেই। চীনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ এ প্রক্রিয়ায় দ্রুত সফলতা পেয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত অনেক আগেই ‘জনতার কারফিউ’ জারি করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিলগেটসও করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মানুষে মানুষে দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ বর্তমান সংকট নিয়ে আপনার সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা কোনটি? এই সময়ে কী আপনাকে সবচেয়ে বেশি আশান্বিত করে? উত্তরে তিনি বলেছেনÑ ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ধনী দেশগুলোয় বহু আক্রান্ত ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পরীক্ষা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার (যাকে আমি শাটডাউন বলছি) মতো সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দু-তিন মাসের মধ্যে উচ্চমাত্রার সংক্রমণ এড়াতে পারা উচিত ধনী দেশগুলোর। অর্থনৈতিক ক্ষতিই আমার দুর্ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্ভাবনা হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশগুলো নিয়ে, যাদের ধনী দেশগুলোর মতো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ নেই, যাদের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতাও কম।’
যেহেতু বিশেষজ্ঞসহ সকলেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকেই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে দেখছেন তাই আমরা মনে করি সরকার ঘোষিত দশ দিনের এই ছুটিকে আমাদের কাজে লাগতে হবে। আমরা যেন এই ছুটিকে উপভোগের উপলক্ষ্য করে না ফেলি। ‘লম্বা ছুটি পেয়েছি তাই একটু বেড়িয়ে আসি’Ñ এমনটা যেন কল্পনাতেও না আনি। বরং যে যেখানে আছি এই দশদিন সেখানেই যেন অবস্থান করি। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে তৎপর সেনাবাহিনীকে আমরা যেন সহযোগিতা করি। লেখাটি শেষ করবো করোনার ভয়বহতার সময়ে চীনের উহান প্রদেশে ১০ দিনের লকডাউন কাটানো বাংলাদেশী এক গবেষকের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে। চায়নার উহানে অবস্থিত ‘ইউনিভার্সিটি অব জিওসাইন্সেস’-এ গবেষক হিসেবে কর্মরত ইসরাত জাহান লিজা নামে সেই নারী লকডাউনের দশদিন কিভাবে নিজের বাড়িতে কাটিয়েছেন তার বর্ণনা লিখে ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। তার সেই লেখাটি আমার সময়োপযোগী মনে হয়েছে। যেহেতু বাংলাদেশকেও এখন লকডাউনের মত করেই দশদিনের ছুটিতে যেতে হচ্ছে তাই তার লেখাটি সবার জন্য শেয়ার করা উচিত  বলে মনে করছি। ইসরাত জাহান লিজার সেই লেখাটি নিচে হবহু তুলে ধরলাম।
‘উহানে আমি ১০ দিন পুরো লকডাউন এ কিভাবে বাচ্চা নিয়ে ভালো ছিলাম তা নিয়ে অনেকেই আমাকে ইনবক্স করছেন। তাই ভাবলাম সবাইকে একবারে বলিÑ লকডাউনের দিনগুলোতে আমি যা যা করেছি- ১। নামাজ, কোরআন পড়ে এবং আসতাগফার পড়ে আল্লাহর কাছে এই বিপদের মুক্তি চেয়েছি। ২। উহান লকডাউন হবার পর থেকে একবারও কারো সাথে দেখা হয়নি এবং জানুয়ারি মাস পুরো সময় একবারের জন্য বাসার বাইরে যাইনি আমি আর বাচ্চা। শুধুমাত্র মেয়ের বাবা বাইরে গিয়েছেন সপ্তাহে একবার বাজার করতে। ৩। প্রতিবার যে বাসার বাইরে গিয়েছে সে আসার আগে বাইরে বসেই কিছু ড্রেস খুলে বাসায় ঢুকে সরাসরি গোছল করেছে। ততটা সময় আমি বা মেয়ে আলাদা রুম-এ থেকেছি। মেয়ের বাবা যেহেতু বাইরে যেত তাই মেয়েকে কম টাচ করেছে বা রুমে এসেছে। ৪। প্রচুর পরিমাণে কুসুম গরম পানি, আদা গরম চা, ভিটামিন সি, লেবু গরম পানি, স্যুপ বেশি খেয়েছি সবাই। মেয়েকে প্রতিদিন তার পুষ্টিকর খাবার দিতে চেষ্টা করেছি। ৫। দিনে যতবার মনে হয়েছে এমন কিছু ধরেছি যাতে জীবাণু থাকতে পারে ততবার হাত মুখ ধুয়ে নিয়েছি। বার বার হাত ধুলে উল্টো ঠান্ডা লাগতে পারে। ৬। হাচি-কাশি বা সর্দি ফেলতে সব-সময় টিস্যু ব্যবহার করেছি। তারপর সাবান দিয়ে অন্তত ২০ সেকেন্ড হাত ধুয়েছি। ৭। বাসার বাইওে গেলে মাস্ক ব্যবহার করা মাস্ট। ৮। মনকে ভালো রাখার জন্য মাঝে মাঝে মা-বাবার সাথে কথা বলেছি আর  মেয়ের পুরাতন ভিডিও দেখেছি বা প্রিয় গান শুনেছি। ৯। মাইনাস তাপমাত্রাতেও প্রতিদিন গোসল করে পরিচ্ছন্ন থেকেছি, পাঁচ বার অজু করেছি। তবে মেয়েকে ২/৩দিন পর গোছল করিয়েছি যাতে কোনভাবেই ঠান্ডাজনিত কারণে হাসপাতালে না যেতে হয়। ১০। বাইরে থেকে কিনে আনা ফল, সবজি, ডিম এমনকি কৌটার কিছু আনলেও সাবান পানি (লিকুইড) দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়েছি। ১১। স্বাভাবিক বাতাস আসার জন্য দিনে ৩ ঘন্টা জানালা খোলা রেখে বাকি সময় বন্ধ রেখেছি। ১২। মাছ মাংস কম খেয়েছি তবে যা খেয়েছি অবশ্যই অনেক বেশি সিদ্ধ করে নিয়েছি। ১৩। মেয়ের সাথে অনেক সময় কাটিয়েছি যাতে সে হঠাৎ করে আটকে থেকে মন খারাপ না করে। তাকে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ কাজ এ ব্যস্ত রেখেছি। যদিওবা মোবাইল বা ল্যাপটপ-এ সে কার্টুন দেখতে পছন্দ করে না তবুও দিয়েছি কিছুসময়। ১৪। বাসা ক্লিন রেখেছি সাথে সাথে বাইরে থেকে এসে চাবি, বাসার লক, কলিং বেল হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে ক্লিন করেছি। ১৫।প্রতিদিন বাসার সবাই শরীরের তাপমাত্রা চেক করেছি থার্মোমিটার দিয়ে। ১৬। যেহেতু চায়নাতে ম্যাক্সিমাম লেনদেন অনলাইন এ হয় তাই টাকা হাতে ব্যবহার করিনি। আর বাজারে হ্যান্ড গ্লোভস পরা খুব জরুরি। ১৭। পরিবারকে সর্বোচ্চ সময় দেওয়ার চেয়ে ভালো আর কিছুই নাই। মেয়ে আর আমি হাজার গল্প করেছি। রান্না করেছি। যদিওবা অনেক বেশি মানসিকভাবে ঠিক থাকতে এগুলো অনেক উপকারী। কারণ মন খারাপ হলে শরীর দ্রুত খারাপ হয়।
লেখক ঃ প্রাবন্ধিক ও ব্যবস্থাপক,
ট্রাস্ট ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, বগুড়া

আরও খবর

Sponsered content

Powered by