উপ-সম্পাদকীয়

কেন কাব-স্কাউটিং? স্কাউটিং এর শুরু হোক প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই

  প্রতিনিধি ২৬ অক্টোবর ২০২২ , ৬:৪৮:২৪ প্রিন্ট সংস্করণ

হাসান মারুফ ,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গৌরীপুর, ময়মনসিংহ  ।

মতামত:

স্কাউটিং এমন একটি আন্তর্জাতিক, শিক্ষামূলক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন- যা শিশু, কিশোর ও যুবকদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, বুদ্ধিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে জ্ঞান দান করে সুনাগরিক হওয়ার যোগ্য করে গড়ে তোলে।  ১৯০৭ সালে ব্রাউন্সী দ্বীপে রবার্ট স্টিফেনশন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল (বি.পি) শিশুদের যে কোনো বিষয় শেখানোর সহজ পদ্ধতি জানার জন্য পরীক্ষামূলক একটি ক্যাম্প করেন শিশু-কিশোরদের নিয়ে এবং তিনি লক্ষ করেন মুক্তাঙ্গনে বিভিন্ন আকর্ষণীয় কর্মসূচির মাধ্যমে কোনো বিষয় শেখানো হলে তা বেশী স্থায়ী ভাবে মনে থাকে ও তারা সে বিষয় এ বেশী উদ্বুদ্ধ হয়।

এভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহজেই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ সাধন করা যায়। এভাবেই স্কাউট আন্দোলন এর শুভ সূচনা হয়। এই আন্দোলনে রয়েছে শৃংখলা,উদ্যম ও সৃষ্টিশীলতার অপার আনন্দ। কারো স্কাউটিং এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এ অপার আনন্দের স্বাদ নিতে হলে নিজেকে যুক্ত করতে হবে এই আন্দোলনে। আমাদের এখানে ১৯৭২ এর এপ্রিল মাসে সারা দেশের স্কাউট নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক সভায় মিলিত হয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি। ঐ বছরেরই যা রাষ্ট্রপতির ১১১ নং অধ্যাদেশ বলে (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, সোমবার) সরকারি স্বীকৃতি লাভ করে। এর আগে অবশ্য ১৯৪৮ সালের মে মাসে ঢাকায় গঠিত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল স্কাউট এসোসিয়েশন। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রবীণ স্কাউটার সলিমুল্লাহ ফাহমীর। বিশ্ব স্কাউট সংস্থা ১৯৭৪ সালের ১ জুন বাংলাদেশ স্কাউট সমিতিকে ১০৫ তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৭৮ সালের ১৮ জুন পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল সভায় সমিতির নাম বদলে রাখা হয় বাংলাদেশ স্কাউটস।

ছাত্র-ছাত্রীদের স্কাউটিং করার বিভিন্ন ইতিবাচক দিক রয়েছে। স্কাউটিং একদিকে যেমন নিয়মানুবর্তী হতে সাহায্য করে, চরিত্র গঠনে সহায়তা করে, সদা সত্যবাদী হওয়ার শিক্ষা দেয়, চৌকস হতে সাহায্য করে, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে উদারতার শিক্ষা দেয়, জীবনমুখী শিক্ষা দেয়, আত্মনির্ভরশীল করে, কর্মঠ করে গড়ে তোলে; পাশাপাশি শ্রমের মর্যাদা শেখায়, শরীর মন সুস্থ্য সবল রাখতে সহযোগীতা করে এবং অবসর সময়কে গঠনমূলক কাজে লাগিয়ে মুল্যবোধ অবক্ষয় রোধে সহায়তা করে। আবার স্কাউটিং উপদল পদ্ধতিতে পরস্পর সহযোগীতার মাধ্যমে কাজ করার মনোবল গড়ে তুলে , নিয়মানুবর্তি ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে শেখায়,নিজের কর্মক্ষমতার উপর আত্মবিশ্বাসী হতে শেখায়, গণতান্ত্রিক মনোভাব গড়ে তুলে, সাংগঠনিক ভাবে এবং ব্যক্তিজীবনে নেতৃত্ব প্রদান সহজ হয়, মানুষের মানবিক ও গুণাবলি বিকাশ সাধিত হয় এবং স্কাউটিং নেতৃত্ব ও দায়িত্ববোধের বিকাশের মাধ্যমে জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

স্কাউট আন্দোলন শিশু-কিশোরদের বৈচিত্রময় কর্মসূচিতে পাঠদানের মাধ্যমে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করে। তাদের মনের অন্ধকার দূর করে দেখায় আলোর পথ।
যেখানে সাধারণ জনগণরা রাস্তার ময়লা-আবর্জনা দেখে মুখ ফিড়িয়ে নেয় সেখানে স্কাউট আদর্শ বুকে ধারণ করা স্কাউট সদস্যরা দেশকে ভালোবেসে নিজ হাতে ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে। দেশকে সবুজ-শ্যামল সুন্দর করতে বৃক্ষরোপণ করে। শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে,তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শিশুদের টিকা প্রদানে নিরলসভাবে অংশ গ্রহণ করে, সেবা প্রদান করে। নিজের জন্য নয় বরং দেশের জন্য সর্বদা কাজ করে দেশকে নিস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে। এভাবে সকল ক্ষেত্রে স্কাউটিং এ যুক্ত সদস্যরা কাজ করে নিজেদের নাম প্রচারে নয় বরং দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে দেশ কে মন থেকে ভালোবেসে। এছাড়াও সমাজ থেকে ইভটিজিং, মাদক, বাল্য বিয়ে বন্ধ ও নারী নির্যাতনসহ নানান সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধেও আমরা স্কাউটদের কাজে লাগাতে পারি।

বাংলাদেশ স্কাউটিং প্রধানত তিনটি স্তরে বিভক্ত। ৬ থেকে ১০+ বছর বয়সী শিশুদের জন্য কাব স্কাউটিং, স্কুল ও মাদ্রাসার ১১ থেকে ১৬+ বছর বয়সী বালক-বালিকাদের জন্য স্কাউটিং ও কলেজ বিশ্ববিদ্যলয়ের ১৭-২৫ বছর বয়সী যুবকদের জন্য রোভার স্কাউটিং। কাব অর্থ শাবক বা বাচ্চা। কাব স্কাউটিং এ নেকড়ে বাঘের বাচ্চাদের কথা বুঝানো হয়েছে। ১৯১৪ সালে উল্ফ কাব নামে কাব স্কাউটিং প্রবর্তিত হয়। যারা কাব স্কাউটিং করে তাদের বলা হয় কাব স্কাউট। যে সকল কিশোর-কিশোরীর বয়স ৬ বছরের বেশি কিন্তু ১১ বছরের কম তাদের জন্য কাব স্কাউটিং।

কাব স্কাউটিং নেতৃত্ব দানে পারদর্শী করে তোলে পারদর্শী। ছোট বেলা থেকেই একটি দলে থাকার মজা এবং কাজগুলো ভাগ করে নেয়ার শিক্ষা দিয়ে দেয় কাব স্কাউটিং। ফলে কাজটা কিভাবে শেষ করা যাবে কিংবা কাকে দিয়ে করালে ভাল হবে, সেই নেতৃত্ব গুণ থাকে একজন কাব স্কাউট এর। ফলে নতুন করে কোনো কিছুই বুঝে নিতে হয়না, জীবনে সকল কাজেই সফলভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে সে। আবার কারো সাথে থেকেও শেষ করতে পারে যে কোন কাজ। এ সকল গুণের স্বীকৃতি স্বরূপ কাব স্কাউটদের দেয়া হয় শাপলা কাব এ্যাওয়ার্ড। কাব স্কাউটদের রয়েছে সুনির্দিস্ট প্রতিজ্ঞা। যা হল “আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে, আল্লাহ ও আমার দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করতে, প্রতিদিন কারো না কারো উপকার করতে, কাব স্কাউট আইন মেনে চলতে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব। (অন্য ধর্মালম্বীগণ ‘‘আল্লাহ’’ শব্দের পরিবর্তে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস মতে সৃষ্টিকর্তার নাম উচ্চারণ করতে পারে)। এছাড়াও কাব স্কাউট আইন হলো বড়দের কথা মেনে চলা এবং নিজেদের খেয়ালে কিছু না করা। যা শিশুদের বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাশীল হিসেবে গড়ে তোলে এবং সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে শেখায়।

কাব স্কাউট মটো হচ্ছে ‘‘যথাসাধ্য চেষ্টা করা’’; যা তাদের পরিশ্রমী ও উদ্যোগী করে তোলে। কাবিং এর মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তারা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে নিজেদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবে। কাবদের নিজস্ব পোশাক থাকে। কাবিংয়ের মাধ্যমে শিশুদের আঙ্গুলের বিশেষ কায়দায় সালাম দেয়া ও গ্রহণ করা, ডান হাতে করমর্দন করা ইত্যাদি বিষয় শেখানো হয়। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুরা নিয়মশৃঙ্খলার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে যা পরবর্তী জীবনে তাদের চিন্তা, কথা ও কাজে নির্মল হতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীদের বয়স সাধারনত ৬ থেকে ১১ বছর। এই বয়সী শিশুদের পাঠক্রম এর সাথে কাব স্কাউট কার্যক্রমে অংশগ্রহণ তাদেরকে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সৎ, চরিত্রবান, কর্মোদ্যোগী, সেবাপরায়ণ, সর্বোপরি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। কাব স্কাউটিং পড়ার পাশাপাশি আনন্দের মাধ্যমে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখতে সাহায্য করে। কাব স্কাউটিং শিশুকে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলে। অপরকে সাহায্য করার মনোভাব শিশু বয়স থেকেই গড়ে ওঠে। একজন কাব স্কাউট দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল সম্পর্কে জানতে পারে। কাব স্কাউটরা পরবর্তীতে যোগ্য নাগরিক হয়ে সঠিক পথে সমাজ ও দেশকে পরিচালিত করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে সোনার মানুষ প্রয়োজন। সে কারণে সমাজে সোনার মানুষ তৈরির জন্য সৎ, যোগ্য, আদর্শ ও দক্ষ নাগরিক হিসাবে ভবিষৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাব স্কাউটিংয়ের আদর্শকে ছড়িয়ে দিতে হবে। শিশুরা আনন্দময় পরিবেশ ভালোবাসে। তারা আনন্দের মাঝে বড় হতে চায়। আনন্দের মাঝে নতুন কিছু শিখতে চায়। কাব স্কাউটিং কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই, ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশ গড়তে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাব স্কাউট কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করা উচিৎ।

লেখক: হাসান মারুফ ,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা
গৌরীপুর, ময়মনসিংহ  ।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by