উপ-সম্পাদকীয়

ছোটবেলা থেকেই উদার ও পরোপকারী ছিলেন মুজিব

  প্রতিনিধি ১৬ মার্চ ২০২৩ , ৩:৪২:২০ প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম বাবুল

ছোটবেলা থেকেই গরীব দুখীদের খোঁজ নিতেন মুজিব। কারো দুঃখ-কষ্ট দেখলে তিনি তার পাশে এগিয়ে যেতেন। নিজের জামা-কাপড় অন্যকে পরিয়ে দিয়ে খালি গায়ে বাড়ি ফিরতেন। নিজের খাবার অন্যদের মাঝে ভাগাভাগি করে খেতেন। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের সঙ্গে অত্যান্ত সহজভাবে মিশতেন। শৈশবকাল কেটেছে গ্রামের আরো দশটা ছেলের মতো নদীতে ঝাঁপিয়ে, মেঠো পথের ধুলো-বালি মেখে, বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। গাছে গাছে পাখির বাসা দেখে। পাখির ছানা পুষতে ও সারাদিন গ্রামের ছোট ছোট ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিক ঘেঁষে একটা সরু খাল চলে গেছে, যে খাল মধুমতী ও বাইগার নদীর সংযোগ রক্ষা করে। এই খালেই সাঁতার কেটেছে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের সাথে। খালের পাড়েই ছিল বড়ো কাচারি ঘর। কাচারি ঘরের পাশে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাদের কাছে মুজিব বাংলা, আরবি, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন। পূর্বপুর পুরুষদের গড়ে তোলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল বাড়ি থেকে প্রায় সোয়া কিলোমিটার দূরে। মুজিব এই স্কুলেই প্রথম লেখাপড়া শুরু করেন।

গ্রামের সব ছেলে-মেয়ে থেকে মুজিব একটু অন্যরকম ছিলেন। গ্রামের মুরব্বি, শিক্ষক, কৃষক, মাঝি সকলে একবাক্যে স্বীকার করতেন-এই বাচ্চাটা সবার চাইতে আলাদা, অন্যরকম এবং এই বাচ্চার মনটা অনেক বড়ো, অনেক উদার ও পরোপকারী। এলাকার মুরব্বী, বঙ্গবন্ধুর জেষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ ও কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার ‘আমার বাবার ছেলেবেলা’ ও বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে তাঁর ছোটবেলার কথা জানা যায়।

একবার এলাকায় খুব প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো। ফলে ফসলের অনেক ক্ষতি হলো। ঘরে ঘরে খাবারের জন্য হাহাকার। ছোটো মুজিবের মনে খুব কষ্ট মানুষের এই দুঃখ-দুর্দশা দেখে। বাবা-মাকে বলে গোলাঘর থেকে ধান-চাল বিলানো শুরু করলেন। এমনকি ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অবস্থাসম্পন্নদের কাছ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে, যাদের নেই তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। মুজিবকে সবাই এত ¯েœহ করতেন, এত ভালোবাসতেন যে, তাঁকে কেউ ফিরিয়ে দিতেন না। একবার বাবা লুৎফর রহমান কলকাতা থেকে সুন্দর একটা শাল কিনে আনলেন। মুজিব সেই শাল গায়ে দিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছেন। ফিরবার পথে দেখতে পেলেন, গাছের নিচে একজন জীর্ণশীর্ণ বয়স্ক মানুষ প্রচন্ড শীতে কাঁপছেন। তাই দেখে মুজিব নিজের গা থেকে ওই বয়স্ক মানুষটার গায়ে চাদরটা জড়িয়ে দিলেন এবং নিজে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরলেন। মা সায়েরা খাতুন খেয়াল করলেন, খোকা শীতে কাঁপছে! কিন্তু গায়ের গরম চাদরটা নেই। মা প্রশ্ন করার আগেই তাঁর আদরের খোকা বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন। পাশে বসে থাকা বাবা বললেন, খুব ভালো কাজ করেছ খোকা। আল্লাহ তোমাকে ভালো করবেন। আরেকদিন গায়ের শার্টটা খুলে গেঞ্জি গায়ে বাড়ি ফিরলেন। কারণ বন্ধুটি খালি গায়ে স্কুলে যেতে পারছিলো না। তাই নিজের গায়ের শার্টটি বন্ধুকে খুলে দিলেন। বাবা-মা ছিলেন অত্যন্ত উদার প্রকৃতির। তিনি যখন কাউকে কিছু দান করতেন তখন বাবা-মা তাকে বকাঝকা করতেন না বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে মুজিবের মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ, যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে বাবা লুৎফর রহমান তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ যুগিয়েছেন।

হাসি আনন্দের মাঝে হঠাৎ করে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন বাবা-মার আদরের খোকা। সকলেই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। দোয়া-ছদকা-মানত, ডাক্তার-কবিরাজ-অ্যালোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি কোনোকিছুই বাদ নেই, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এর মধ্যে চোখেরও খুব সমস্যা শুরু হলো। সময় নষ্ট না করে কলকাতায় নিয়ে গেলেন খোকাকে। বড়ো বড়ো ডাক্তার দেখানো হলো, ওষুধপত্র ঠিকভাবে চলতে থাকল; চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়ে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। রিপোর্ট দেখে ডাক্তার বললেন, বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হয়েছে খোকা। প্রচুর পরিমাণে বিশ্রাম নিতে হবে, ভালো খাবার আর ফলমূল খেতে হবে। বেরিবেরি হলো ভিটামিন বি-১ স্বল্পতা। চোখের ডাক্তার রিপোর্ট দিলেন গøুকোমা, যত তাড়াতাড়ি অপারেশন করা যায়, ততই মঙ্গল। বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, কিন্তু উপায় নেই, অপারেশন করতে হবে। তা না হলে অন্ধ হয়ে যাবে খোকার দুটি চোখ। অবশেষে চোখের অপারেশন সম্পন্ন হলো।

ডাক্তারের পরামর্শে বই পড়া ও খেলাধুলা বন্ধ রাখতে হলো। আদরের সন্তান যেন একাকিত্ব অনুভব না করে এ জন্য পাড়ায় বন্ধুরের ডেকে উঠানে এনে তাদের সাথে খোকাকে গল্প করিয়ে মন ভালো রাখার চেষ্ঠা করা হতো। খোকাকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে এবং লেখাপড়ার সান্নিধ্যে রাখার জন্য বাবা লুৎফর রহমান নিজে বিভিন্ন ধরনের বই পড়ে শোনাতেন এবং মা সায়েরা খাতুন কলের গান শোনাতেন।

নিজে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার পরও গ্রামের মানুষের দুঃখ-দুর্দশার খোঁজ নিতে ভুলে যাননি মুজিব। পাড়ার বন্ধুরা কাছে আসলে তাদের মাধ্যমে সকল খোঁজ-খবর নিতেন তিনি। আজকে কি কি হলো- স্কুলের সব ঘটনা, কোন পাখির বাসায় ডিম-ছানা দিয়েছে, আক্কেলের মাকে কি মা চাল পাঠিয়েছেন? কলিমুদ্দিনকে কি মাছ ধরার জন্য নতুন জাল কিনে দেওয়া হয়েছে? মন্নাফ মাঝির নৌকার আলকাতরার ব্যবস্থা কত দূর? মইফুল বুর ছেলের জন্য ছেপারা, খরম, লুঙ্গি। বড়োজান বুজির কুপিটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাকে কি নতুন একটা হারিকেন কিনে দেওয়া হয়েছে? তসিরুদ্দিন মামুর হুকোর কল্কিটা ভেঙে গেছে, তার কি ব্যবস্থা হয়েছে? ধলা বউখানার সুপারি-পান ঠিকমতো ব্যবস্থা করা হয়েছে? সব খবর নিতেন খোকা। এ সব তাঁর নখদর্পণে। আর এ সব মা খোকার বন্ধুদের নিয়ে করতেন। বন্ধুরা কখনও খালি হাতে আসত না। কেউ মুড়ি-মোয়া, কেউ নারকেলের তক্তি, আতা, পেয়ারা। মা রাখতেন ডাব, দানাদার, মিষ্টি; সবই উঠানে বসে ভাগাভাগি করে খেত। এ ভাবে প্রায় কেটে গেল চারটি বছর। এর মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার ডাক্তারের কাছে যেতে হয়েছে ফলোআপের জন্য।
পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় ডাক্তার সাহেব মুজিব কে প্রশ্ন করলেন, মুজিব তুমি কীভাবে এতগুলি বছর এত সুন্দর করে পার করলে? মুজিব এক এক করে সবকিছু বর্ণনা করলেন-৪ বছরের ঘটনা। ডাক্তার সাহেবের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন- ইতিহাসের সন, তারিখ, ইংরেজি-বাংলা কবিতা, বিজ্ঞান, নামতা, টাইম-টেবিল ইত্যাদি। ডাক্তার বিস্ময় বালকের দিকে মুগ্ধ হয়ে দেখলেন। ডাক্তার সাহেব বাবা লুৎফর রহমান কে বললেন, আমি প্রতিদিন অনেক রোগী দেখি, অনেক ছাত্র পড়াই, এত মানুষের সান্নিধ্যে আসি, একটা কথা না বলে আর পারছি না। আপনি নিঃসন্দেহে একজন গর্বিত পিতা। এই মুজিব তো সাধারণ ছেলের মতো না। একটা রতœ। দেখবেন, এই ছেলের পৃথিবীব্যাপী অনেক নাম হবে।
ওই ডাক্তার খোকাকে বড়ো এক প্যাকেটে বেশ কিছু বই উপহার দিয়েছিলেন।

এবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে লাগলেন মুজিব। খেলাধুলা, মাছ ধরা, পাখির বাসা খোঁজা, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে খবর নেওয়া। জীবনের কয়েকটা বছর বাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে চললেন। স্কুলে আবার ভর্তি করানো হলো। গিমাডাঙ্গা হাই স্কুলে। প্রথম দিন ক্লাস করতে গিয়ে খুব অস্বস্তি লাগছিল সব জুনিয়র ছেলেদের সাথে। কারণ মুজিবের বন্ধুরা তখন উপরের ক্লাসে। ৪ বছর পড়াশোনা বন্ধ ছিল। বাড়ি ফিরলেন। মুখটা মলিন, লজ্জা-সংকোচ। মায়ের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললেন, মা আমি আর স্কুলে যাব না। বাবা-মা পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল খোকাকে আর এ স্কুলে পড়ানো যাবে না। বাবা যেখানে চাকরি করে ওখানে খোকা পড়াশুনা করবে। গোপালগঞ্জের মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হলো মুজিবকে। ক্লাসের সবার চাইতে বড়ো। চোখে চশমা। ছিপছিপে গড়ন। সুদর্শন এক বালক ক্লাসের সকলের সাথে খুব ভাব হয়ে গেল। স্কুলেও জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বয়সে বড়ো দেখে সবাই মিয়া ভাই ও ভাইজান বলে ডাকে।

এই কিশোর বালকের মধ্যে বিশেষ একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সাথে মিশে যেতে পারত। একবার কেউ ওনার সান্নিধ্যে আসলে সে ভক্ত হয়ে যেত। ঠিক চুম্বকের মতো আকর্ষণ করত। এর মধ্যে আবার ঝড়-তুফান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হলো। খাবারের অভাব, চারিদিকে হাহাকার। কিশোর মুজিবের মনে প্রচন্ড দুঃখ-বেদনা-কীভাবে কি করবে? স্কুলের শিক্ষক-ছাত্র সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করল-যারা বিত্তশালী, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে যারা অনাহারী তাদের ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে। যারা বাচ্চাদের স্কুলের বেতন দিতে পারত না, বইখাতা কলম কিনতে পারত না, তাদের বাচ্চাদের সাহায্য করা হতো ওই চাল থেকে কিছু চাল বিক্রি করে। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের জন্য। উদার ও পরোপকারিতার জন্য কিশোর মুজিবের নাম তখন গোপালগঞ্জে অনেক জনপ্রিয়।

লেখক : সভাপতি, ঢাকাস্থ গোপালগঞ্জ সাংবাদিক সমিতি

আরও খবর

Sponsered content

Powered by