ধর্ম

জীবিতদের নিকট মৃত ব্যাক্তির হক

  প্রতিনিধি ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৬:১৩:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ

Mufti Khalid Saifullah

মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে আপনজনের করনীয়ঃ মৃত্যু হচ্ছে মোহনা – এখানে দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি আবার আখেরাতের জীবনের সূচনা। দুনিয়াকে বলা হয় ‘মাযরাতুল আখিরাহ’ বা আখেরাতের শস্যক্ষেত্র। দুনিয়ার জীবন যার যেমন কাটবে, পরকালে এর ফলই সে ভোগ করবে। আর যে কোনো কিছু ভালো হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্যে এর সমাপ্তি সুন্দর হওয়া জরুরী। হাদিসে আছে,
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন আমল তো শেষ অবস্থা অনুসারেই বিবেচিত হবে।”
(সহীহ বুখারী, হাদিস- ৬৬০৭)

আমাদের এক পরিচিত প্রবাদ- শেষ ভালো যার সব ভালো তার। সব মিলিয়ে বলা যায়, আখেরাতের সুন্দর জীবনের জন্য সুন্দর মৃত্যুর বিকল্প নেই। এ জন্যে কোন মুমূর্ষ ব্যাক্তির পাশে যারা উপস্থিত থাকবেন, তাদের প্রথম কর্তব্য- কালেমায়ে তায়্যিবার তালকীন। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
”তোমরা তোমাদের মৃত্যুগামী ব্যাক্তিদের লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর তালকীন করো।”
(সহীহ মুসলিম, হাদিস ৯১৬,৯১৭)

তালকীন এর অর্থ হচ্ছে -মুমূর্ষ ব্যক্তির পাশে একটু আওয়াজ করে কালেমা পড়তে থাকা। তবে মনে রাখতে হবে এ অবস্থায় তাকে কিছুতেই মুখে উচ্চারণ করে কালেমা পড়ার আদেশ করা যাবে না। জোড়াজুড়ি করা যাবে না, এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই নিয়ম হলো , তার পাশে বসে মৃদু আওয়াজে কেবল কালিমা পড়তে থাকা। কালিমা বলুন বা এ জাতীয় কিছু বলা যাবে না। তার পাশে যখন কালেমা পড়া হবে , তিনি যখন কালেমার আওয়াজ শুনতে পাবেন, আশা করা যায়, তিনি নিজেই কালেমা পড়ে নিতে পারবেন। এ কালেমা যার জীবনের শেষ কথা হবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-
”যার শেষ কথা হবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস-৩১১৮)

মুমূর্ষ ব্যক্তির পাশে থেকে সূরা ইয়াসিন তিলায়াত করার কথাও হাদিসে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন-
”মৃত্যু পথযাত্রী যারা, তাদের পাশে থেকে তোমরা সূরা ইয়াসিন পাঠ করো।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস -৩১২৩)
(সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদিস -৩০০২)
ছোট ও সহজ এ দুটি আমলের পাশাপাশি দূরের-কাছের সকলেরই উচিত তার জন্যে দুয়া করা। তার মৃত্যু যেন সহজ হয় এবং ঈমানের সঙ্গে হয় এ দুআ করা। এ দুআটুকুর জন্য পাশে থাকারও প্রয়োজন নেই, কোনো আপনজনের মুমূর্ষের অবস্থার সংবাদ পেলে তার জন্যে যথা সাধ্য দুআ করা উচিত। এতে শুধু তারই উপকার হবে এমন নয়, বরং দুআ কারীর উপকার ও এতে কম নয়। হাদিসের ভাষ্যানুসারে কোন মুসলিম ভাইয়ের জন্য দূর থেকে কোন দুআ করলে ফিরিশতারা বলে তাকেও (দুআকারীকেও) যেন এ বিষয়গুলো দান করা হয়। তাই অন্য কারও জন্যে দুআ করা, কারোও মুমূর্ষ অবস্থায় সহজ মৃত্যু এবং ঈমানের সঙ্গে মৃত্যুর জন্যে দুআ করলে লাভবান হবে দুআকারী নিজেও।

মৃত্যুর পর আপনজনদের করনীয়ঃ
মৃত ব্যক্তিকে সুন্দর ভাবে গোসল করিয়ে কাফন পরানো এবং তার জানাযার নামায আদায় করে তাকে দাফন করা এগুলো আপনজনদের করতে হয়। মাটি থেকেই মানুষের সৃষ্টি, দুনিয়ার শেষ করে মাটিতেই হয় তার শেষ গন্তব্য। কুরআনে কারীমের ভাষায়-
”আমি তোমাদের তা (অর্থাৎ মাটি ) থেকেই সৃষ্টি করেছি, তাতেই আবার তোমাদের আমি ফিরিয়ে নেব এবং তা থেকেই পুনরায় তোমাদের জীবিত করবো।”
( সূরা ত্বহা(২০) :৫৫ )
শরিয়াতের নির্দেশনা অনুসারে গোসল-কাফন-জানাযা ও দাফন সম্পন্ন করা তো আমাদের জানা বিষয়। তবে এক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে- দাফন যেন বিলম্বিত না হয়, নানা কারনেই মৃত ব্যক্তির দাফন বিলম্বিত হয় কখনো দূর-দূরান্তের আপনজনদের অপেক্ষায় , কখনো অধিক মুসল্লির অংশগ্রহনে জানাযা নামায আদায় করার জন্যে, কখনো এক এলাকা থেকে মৃত দেহ অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে দাফন বিলম্বিত হয়। দুনিয়ার এ জীবন যার যত বেশি সামাজিক কর্মে অবদান কিংবা অন্য কোন দিক থেকে যে যত বেশি মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত, তার বিদায়ের সঙ্গে ঠিক ততোবেশি মানুষেরই আবেগ জড়িয়ে থাকে। শেষ বারের জন্য একটু দেখার আকুলতা থাকে। এসবই সত্য। কিন্তু শরিয়তের নির্দেশনা হলো, কেউ যখন মারা যায়, তখন দ্রুতই যেন তাকে দাফন করা হয়। প্রিয় নবীজী (সাঃ) বলেছেন-
”মৃতব্যক্তির জানাযা-দাফন ইত্যাদি দ্রুত করো, সে যদি নেককার মানুষ হয়ে থাকে তবেতো তার জন্য কল্যান ও পুরুষ্কার রয়েছে, তোমরা তাকে সেই কল্যানের দিকেই এগিয়ে দিলে। আর যদি সে এমন না হয়, তবে (দাফনের মধ্য দিয়ে ) তোমরা তোমাদের বাড়ি থেকে এ মন্দ নামিয়ে দেবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস-১৩১৫)
হাদিসের ভাষ্য তো পরিষ্কার -মৃত ব্যক্তি যেমনই হোক, নেককার হোক কিংবা না হোক, দ্রুত দাফনের মধ্যেই রয়েছে কল্যান, হয়তো তার জন্যে, কিংবা জীবিতদের জন্যে।
আরেকটি হাদিসে রাসূল (সাঃ) হযরত আলি (রা) কে বলেন-
”আলী তিনটি জিনিস বিলম্বিত করোনা- নামায, যখন এর সময় হয়ে যায়, জানাযার নামায এবং উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলে মেয়েদের বিয়ে দেয়া। (জামে তিরমিযী, হাদিস-১০৭৫)

এজন্য জানাযার নামায ও দাফন অপ্রয়োজনে বিলম্বিত করা উচিত নয়। জানাযার নামায যদিও ফরযে কেফায়া কিছু মানুষ পড়লেই সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়, কিন্তু জানাযা নামায মূলত একটি দুয়া। মৃত ব্যক্তির জন্য জীবিতদের দুয়া এবং এক মুসলমানের নিকট আরেক মুসলমানের হক। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন-
”এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের পাঁচটি হক রয়েছে-
১. সালাম দিলে তার জবাব দেয়া।
২. অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া।
৩. জানাযায় শরীক হওয়া।
৪. নিমন্ত্রন গ্রহণ করা।
৫. এবং কেউ হাচিঁ দিয়ে আল-হামদুলিল্লাহ বললে তার জবাবে ইয়াারহামুকাল্লাহ বলা।”
(সহীহ বুখারী, হাদিস- ১২৪০)
জানাযার নামাযের পর আসে দাফনের পর্ব। এ জীবনে যারা যত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল, বিদায় বেলায় সাধারনত তারাই তত বেশি সঙ্গ দেয়। কাফন-জানাযা-দাফন সব পর্বেই তারা থাকে। জানাযার নামায শেষে অনেকেই চলে যায় যার যার মতো। আপনজনেরা থাকে, সঙ্গে আরো কেউ কেউ থাকে। জানাযার নামাযের সাথে সাথে দাফন কার্যে অংশ-গ্রহনকারীর জন্য রয়েছে বড় পুরুষ্কারের ঘোষণা। রাসূল (সাঃ) বলেছেন-
” মৃত ব্যক্তির জানাযার নামাযে যে শরীক হয় তার জন্য রয়েছে এক কিরাত। আর যে তাকে দাফন করা পর্যন্ত থাকে তার জন্য রয়েছে দুই কিরাত। কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল -দুই কিরাত মানে কি? তিনি তখন বললেন ‍দুটি বড় পাহাড়ের সমতুল্য।”
(সহীহ বুখারী, হাদিস-১৩২৫)
দাফন পরবর্তী সময়ে মৃতব্যক্তির অধিকারঃ
দুআ ও ইস্তেগফার জানাযা নামাযই মৃতব্যক্তির জন্য একটি দুয়া। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই এক দু’য়াই শেষ নয়। দাফনের পরপরই শুরু হয় তার কবরজগতের প্রশ্নোত্তর পর্ব। পরিক্ষা শুরু সেখানেই। রাসূল (সাঃ) একবার একজনকে দাফন করার পর সেখানে দাড়িয়ে বললেন-
”তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ইস্তিগফার করো সে যেন সত্যের উপর অবিচল থাকতে পারে এখনতো তাকে প্রশ্ন করা হবে।”
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস-৩২২৩)

তাই দাফনের পরপরই মৃত ব্যক্তির জন্য দুয়া করা, তার সওয়াল জবাব যেন সহজ হয়, কবরের প্রতিটি ধাপই যেন সে সহজে পেরিয়ে যেতে পারে এ দুয়া জীবিতদের নিকট তার অধিকার। আরেক হাদিসে দু’য়ার নির্দেশনা এসেছে আরও ব্যপক পরিসরে। নবীজী (সাঃ) বলেছেন-
”মানুষ যখন মারা যায় তখন তার সব আমলই বন্ধ হয়ে যায়। ব্যতিক্রম কেবল তিনটি :
১. সদকায়ে জারিয়া।
২. উপকারী ইলম।
৩. এমন নেককার সন্তান যে তার জন্য দু’য়া করবে।”
মৃত্যু পরবর্তী সময়ের এ দু’য়া সন্তানের নিকট বাবা-মায়ের অধিকার। এ অধিকার এড়াতে পারবে না যারা সরাসরি সন্তান না হলেও ঘনিষ্ঠতায় এবং আন্তরিকতায় মৃত ব্যক্তির সন্তানতুল্য।

ওসিয়ত ও দেনা পরিশোধ-
মৃতব্যক্তির যত দেনা , তার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে সে সবও পরিশোধ করে দিতে হবে। যে ওসিয়ত তিনি করে যান, তাও আদায় করতে হবে, তবে তা পুরো সম্পদ দিয়ে নয় বরং সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে।

ইসালে সওয়াব-
মৃত ব্যক্তির অধিকার আদায়ের জন্য এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘস্থায়ী। ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্য দান সদকা যেমন করা যেতে পারে, এর পাশাপাশি কুরআন তিলাওয়াত, নফল নামায, রোযা, কুরবানী, হজ্ব ইত্যাদি সবই করা যেতে পারে। দুনিয়ার এ জীবনে কেউই চিরস্থায়ী নয় আখেরাতেই আসল গন্তব্য, স্থায়ী নিবাস। সেখানকার জীবন যেন সুন্দর হয় সুখকর হয় উপরোক্ত বিষয় গুলো এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারে। শুরুতেই বলে এসেছি যার সাথে সম্পর্ক যেমন তার প্রতি অধিকারও তেমন। এ অধিকার আদায়ে যত্নবান হতে হবে আমাদে।

মুফতি খালিদ সাইফুল্লাহ
01916-980308
-খতিবঃ মেরাদিয়া কবরস্থান মাদরাসা মসজিদ, খিলগাঁও ঢাকা।

Powered by