বরিশাল

দুর্নীতির দায়ে এমপি পদ হারানোর পর এবার জেলা পরিষদের প্রশাসক হতে চান তিনি!

  প্রতিনিধি ২৩ এপ্রিল ২০২২ , ৪:১৬:৩২ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্কঃ

 

এ যেন মামা বাড়ির আবদার। অবশ্য অন্য যুক্তিতে আবদার তিনি করতেই পারেন, কারণ নানা অনিয়মের আবদার জোর করে পূরণ করেই আজ তিনি পিরোজপুর জেলার বয়জ্যেষ্ঠ রাজনীতিক। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি আর নানা অপকর্ম তার রাজনৈতিক জীবনের সব অর্জন ইতিমধ্যেই ম্লান করে দিয়েছে। সংসদ সদস্য থেকে এখন তিনি দুদকের একাধিক মামলার আসামি। যার নিজের ও স্ত্রীর স্থাবর অস্থাবর সবসম্পত্তি এখন আদালতে নির্দেশে জব্দ করেছে দুদক। কারণ সংস্থাটির অনুসন্ধান-তদন্তে উঠে এসেছে অর্জিত বেশিরভাগ সম্পদই তার অবৈধ। বলছি পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ. কে. এম. এ. আউয়ালের কথা।

সাবেক এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতি ও তথ্য গোপনের দায়ে ২০১৯ ও ২০২০ সালে একে একে ৫টি মামলা করে রাষ্ট্রের দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা দুদক। যার মধ্যে ২টি মানি লন্ডারিং ও বাকি ৩টি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা। এখন পর্যন্ত জমা দেয়া ৩টি মামলার তদন্তে সাবেক এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক কর্মকর্তারা। দন্ডবিধির ৪২০/৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা অনুযায়ী মামলা তদন্ত রিপোর্ট উঠে আসে আসামি এ.কে.এম. আউয়াল ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি খাস জমি ভুয়া ব্যক্তিদের নামে বন্দোবস্ত দেখিয়েছেন। তদন্তে উঠে আসে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা সদরে ভিটি বন্দোবস্ত মামলার মাধ্যমে ৭ জন ব্যক্তির নামে একসনা বন্দোবস্ত পান। পরবর্তীতে দেখা যায় ওই নামের কোন লিজ গ্রহিতাকে পাওয়া যায়নি এবং সরকারের ওই খাস জমি দখল করে রেখেছেন মামলার আসামী এ. কে. এম. আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন। যেখানে নিয়মনীতির ব্যতয় করে স্ত্রীর নামে নির্মাণ করেছিলেন দ্বিতলা ভবনও।

সরকারি জমি দখলে যেন সিদ্ধহস্ত সাবেক এই সংসদ সদস্য। দুদকের করা অপর মামলার তদন্তে উঠে এসেছে জেলার অতিপরিচিত রাজার পুকুর ভরাট করতে অবৈধভাবে প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। যা তিনি দখলে নিয়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে। শক্তির দাপট দেখিয়েছেন জেলার নেছারাবাদ উপজেলায় কয়েকটি মৌজায় বিপুল পরিমাণ সরকারি জমি দখলের জন্য। যেখানে নিজ নামে আউয়াল ফাউন্ডেশনের কার্যালয় নির্মাণ করে নিজ দখলে রেখেছিলেন।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ধারায়ও বর্তমানে অভিযুক্ত একেএম আউয়াল। দুদকের তদন্তে উঠে আসে বৈধ আয়ের বাইরে তিনি ৩৩ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ অর্জন করেছেন। বিপরীতে দুদকের কাছে জমা দেয়া তথ্যে সাবেক এমপি এ.কে.এম. আউয়াল গোপন করেছেন ১৫কোটির বেশি সম্পদের হিসাব। অর্থপাচারের দায়ে আরো একটি মামলা রয়েছে সাবেক এই জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে।

দুদকের অনুসন্ধান আর তদন্তে যেহেতু স্পষ্ট সাবেক এই সংসদের সদস্যের দুর্নীতির বিষয়গুলো। তাই আদালতে নির্দেশে এ. কে. এম. আউয়াল ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীনের সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পদ জব্দ বা ক্রোকের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাবতীয় তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে উচ্চ আদালতও মহানগর আদালতের সম্পদ জব্দের আদেশ বহাল রেখেছেন।

শুধু স্বামী-স্ত্রীই নন ক্ষমতার দাপটে পরিবার অন্য সদস্যরাও বেপরোয়া। দুদকের তদন্তে একজনের লাগাম টেনে ধরা গেলেও এ. কে. এম. আউয়ালের ছোট ভাই পিরোজপুর সদর পৌরসভার বর্তমান মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে দুদকের।

এছাড়া ২০২০ সালের মার্চের শুরুতে একেএমএ আউয়াল পিরোজপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতে হাজির হয়ে তিনটি মামলায় ও তার স্ত্রী লায়লা পারভীন একটি মামলায় জামিন আবেদন করলে আদালত তা না মঞ্জুর করে তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কারাগারে রেখে চিকিৎসা ও ডিভিশন দেয়ারও নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু ওই দিনই এই আদেশের কিছুক্ষণ পরই বিচারক আব্দুল মান্নানকে বদলির আদেশ পাঠানো হয়। যুগ্ম জজ নাহিদ পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত জেলা জজ হিসেবে বসিয়ে ওইদিন বিকেলেই আউয়াল ও তার স্ত্রীর জামিন আদেশ দেন পিরোজপুর জেলা আদালত। বিচার বিভাগের ওপর সাবেক এমপি আউয়ালের এমন প্রভাব ও ক্ষমতা প্রদর্শন নিয়ে ওই সময় দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিলো।

কাগজ কলমের এই দুর্নীতির বাইরেও এ. কে. এম. আউয়াল সংসদ সদস্য থাকার সময়ে ঘুষ বাণিজ্য, ঠিকাদারিতে ১০ শতাংশ কমিশন আর এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে আলাদা বাহিনী নির্যাতনের কথা মনে করতে অনেকে আঁতকে ওঠেন এখনও। এই রাজনীতিকের দুর্নীতি আর অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন তার আপনভাইসহ নিজ দলের অনেক নেতা। এ কারণেই ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচনে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি এ. কে. এম. এ. আউয়ালকে।

দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, দুদক আইনের ৪০৯ ধারা অনুযায়ী আউয়াল পরিবারের দুর্নীতি মামলা প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে। এবং মামলার এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে সর্বোচ্চ শাস্তির দিকেই এগোচ্ছে মামলাগুলো। এছাড়া একেএমএ আউয়াল পরিবারের জামিন কেন বাতিল হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালত রুল জারি করেছেন বলেও জানান আইনজীবী খুরশিদ। শিগগিরই জামিন বাতিলের চুড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে দুর্নীতির জালে জর্জরিত এমন একজন ব্যক্তি, যাকে অপকর্মের জন্য ২০১৯ সালে মনোনয়ন দেয়া হয়নি নিজ দল থেকে, তিনি এবার বসতে চান জেলা পরিষদের প্রশাসকের চেয়ারে। এরইমধ্যে স্থানীয় রাজনীতির মাঠে এই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। জেলার নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এটা হলে তা হবে আমাদের জন্য হবে দুঃখজনক।

আর দুর্নীতি নিয়ে কাজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেসকল জনপ্রতিনিধি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। বিশেষ করে দুদকের মামলার যারা আসামি, সেই মামলার সুরাহা ছাড়া তাদের পুনরায় স্থানীয় সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসালে জনসাধারণের কাছে নেতিবাচক এক বার্তা যাবে। রাষ্ট্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে ম্যান্ডেট তার সাথে শতভাগ সাংঘর্ষিক হবে এই সিদ্ধান্ত।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by