উপ-সম্পাদকীয়

নদীর বুকে চাষাবাদ

  প্রতিনিধি ৩০ মার্চ ২০২০ , ৮:০৭:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর উৎসমুখ প্রতিবেশি দেশ ভারতে। ৫৪টি নদীর পানি ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মাসহ অন্যান্য নদী পানি শূন্য হয়ে পড়েছে। বলতে গেলে বর্ষা মৌসুমের ২/৩ মাস ব্যতিত সারা বছরই নদীগুলো পানির অভাবে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। এক সময়ের প্রমত্তা নদী ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। এসব নদীতে যখন কমবেশি সারা বছরই পর্যাপ্ত পানি থাকতো, তখন মৎসজীবি, নৌকার মাঝি মাল্লাদের জীবন-জীবিকা নির্ভর করতো নদীর ওপর। আজ কিন্তু সে সব শুধুই স্মৃতি। এখন প্রতিটি নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়েছে। জন্ম নিয়েছে সুবিশাল বালু চরের। আর এই চরকে ঘিরে নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার চিত্রও পাল্টে গেছে। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে ভুমিহীন ও প্রান্তিক চাষীরা নদীর বুকে ধানসহ নানা জাতের শাক-সবজির চাষ শুরু করেছে

 নদীতে পানি না থাকায় সেচভিত্তিক চাষাবাদের জন্য ভু-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতে মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক সুপেয় পানির অভাব দেখা দিতে পারে। অবশ্য যা মোকাবেলা করতে ভু-উপরিস্থ পানির ব্যবহারকে নিশ্চিত করতে হবে। এটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় একটি সমস্যা। আবার নদীতে পানি না থাকায় মানুষের জীবন-জীব বৈচিত্র্য এখন অনেকটাই হুমকিতে পড়েছে। যার বিরূপ প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত যেমন: অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। এরপরও মানুষকে প্রতিকুল পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাঁচতে হচ্ছে।
নদী কেন্দ্রীয় জীবন-জীবিকায় যারা এক সময় মাছ ধরতো, আবার কেউ কেউ নৌকা কেন্দ্রিক উপার্জন করে সংসার চালাতো। আজ কিন্তু সেই দৃশ্যপটের পরিবর্তন হয়েছে, যা আগেই বলেছি। কিন্তু নদীকেন্দ্রিক এসব মানুষ এখন চরের বুকে চাষাবাদ করে বেঁচে থাকার লড়াই করছে। জন্ম নিয়েছে নদী চাষীর। যারা নদীর সুবিশাল চরের নিচু জায়গায় বোরো, কাউনের চাষ করছে।

 
 আসার উঁচু চরে কুমড়া, তরমুজ, আলু, ভুট্টা চাষ করে নিজেদের সংসার চালাচ্ছে। শুধু সংসার চালানোই নয়, অনেক ভুমিহীন প্রান্তিক চাষীরা স্বাবলম্বিও হচ্ছেন। জন্মসুত্রে আমার বসবাস কুড়িগ্রাম জেলায়। দেশের পশ্চাৎপদ জেলা কুড়িগ্রামের দারিদ্র ও ভুমিহীন মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এ জেলার ৯টি  উপজেলার মধ্যে চিলমারী উপজেলার চরের সংখ্যা অনেক বেশি। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদী চিলমারী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে অনেক আগেই তিনটি ইউনিয়ন করালগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বিলীন হয়েছে। বাকীগুলোরও অংশ বিশেষ নদী গর্ভে চলে গেছে। উপজেলা সদরের পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন রোধ করা সম্ভব না হলে হয়ত এতদিনে চিলমারী উপজেলার শেষ চিহ্নটুকু নি:শেষ হয়ে যেত। এই নদীর জেগে ওঠা চরে বিভিন্ন এনজিও’র আর্থিক সহযোগিতায় নদী চাষীরা জোটবদ্ধভাবে কুমড়া, স্কোয়াশ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। ব্রহ্মপুত্র নদীটির গাইবান্ধা অংশে ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে গত বছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। এবছরও ভুট্টা চাষীরা চরের বুকে ভুট্টার চাষাবাদ করেছে। আবহাওয়া অনূকুলে থাকলে ফলন ভালো হবে। যেহেতু স্বল্প পানিতে এবং বালুময় জমিতে ভুট্টা চাষ ভাল হয়, সেহেতু ভুট্টা চাষ করে নদী চাষীদের অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বিপত্তির জায়গাটি হচ্ছে, বাড়তি ফলন হলেই আমাদের দেশের কৃষকদের কপাল পোড়ে। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে চাষীরা বঞ্চিত হন। ফলে চাষীরা লোকসানের মুখে পড়েন এবং এক পর্যায়ে লোকসানি পণ্য উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

যেহেতু আমাদের দেশে সম্ভাবনাময় পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটছে। আর পোল্ট্রি শিল্পের মুরগীর সুষম উপযোগী খাদ্য হচ্ছে ভুট্টা। কিন্তু এ অঞ্চলে পোল্ট্রি শিল্পের খাদ্য উপযোগী ছোট বড় কোন কারখানা গড়ে উঠেনি। গত বছর গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক ফুলছড়ি উপজেলার চরাঞ্চলে ভুট্টা চাষীদের সফলতা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে ভুট্টা চাষীরা দাবি করেছেন, এ অঞ্চলে যেন পশু-পাখির খাবার তৈরি উপযোগী কৃষি ভিত্তিক শিল্প স্থাপন করা হয়। তাহলে ভুট্টা চাষীদের ভুট্টা বিক্রির উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং ভুট্টা চাষীরা লাভবান হতে পারবেন। পরিদর্শনের সময় ফুলছড়ি উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মোঃ আসাদুজ্জামান বলেছিলেন, ফুলছড়ি উপজেলার সাত ইউনিয়নে ৪ হাজার ৩’শ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। বিঘাপ্রতি জমিতে ৩৫ থেকে ৪০ মণ ফলন হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলের পলি ও দোঁআশ মাটির পরিমাণ বেশি, যা ভুট্টা চাষের জন্য উপযুক্ত। তিনি দাবি করেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভুট্টা চাষীদের সঠিক পরামর্শ প্রদান এবং ভুট্টা চাষীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় এই এলাকায় ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরাও মনে করি, সরকারের তরফে নানাভাবে সহায়তা প্রদান করা হলে এবং ভুট্টা চাষীদের উৎপাদিত ভুট্টার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ভুট্টা চাষে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

 
ক’বছর আগের কথা। নিলফামারী জেলায় ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানটি কৃষকের সুখ-দুঃখের এবং কৃষির উন্নয়নে বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। এ অনুষ্ঠানটিতে সরকারের কোন না কোন মন্ত্রী উপস্থিত থেকে কৃষকের সমস্যার কথা শুনেন এবং তা নিরসনে করণীয় সম্পর্কিত মতামতও দিয়ে থাকেন। নিলফামারীর ঐ অনুষ্ঠানে চাষীরা দাবি করেছিলেন, ধান, চাল, গম অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করে যেভাবে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্যে সরকার নিশ্চিত করে থাকে, অনুরূপ পদ্ধতিতে সরকার অভ্যন্তরীণভাবে ভুট্টা সংগ্রহ করলে ভুট্টার উপযুক্ত মূল্য চাষীদের নিশ্চিত হতো। সেদিন অর্থমন্ত্রী সরকারিভাবে ধান, চাল, গমের ন্যায় ভুট্টা অভ্যন্তরীণ ভাবে সংগ্রহ করবে মর্মে আশ্বস্ত করেছিলেন। অর্থমন্ত্রীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ভুট্টা চাষীরা স্বপ্ন বুনলেও দীর্ঘ সময়েও সরকারিভাবে ভুট্টা সংগ্রহের কোন উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। আমরা মনে করি, কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভর করে আমাদের দেশ সমৃদ্ধ হচ্ছে। এই কৃষি খাতকে সরকার পরিকল্পিতভাবে সহায়তা দিলে আগামী দিনে শুধু কৃষি চাষাবাদ করেই দেশীয় চাহিদা মেটানোর পরও উৎপাদিত কৃষি পণ্য বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হবে।

বিশেষ করে নদী অববাহিকায় গড়ে ওঠা নতুন নতুন চরে চাষাবাদের যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে, সে দুয়ারকে প্রসারিত করতে পারলে ভুট্টা চাষের পাশাপাশি নানা জাতের সবজি উৎপাদন করা সম্ভব। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে গোটা বিশ্বে ৪র্থ স্থানে অবস্থান করছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, বাড়তি ফলন হলেই চাষীদের কপাল পুড়ে। যেমন টমেটো, বেগুন, আলুর বাড়তি ফলন হলেই উপযুক্ত মূল্য থেকে চাষীরা বঞ্চিত হন। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সংরক্ষণ উপযোগী পর্যাপ্ত হিমাগার নির্মাণ করা। উল্লেখ্য, সরকার খাদ্য শস্য উৎপাদনে যে পরিমাণ সহায়তা কিম্বা প্রণোদনা দিয়ে থাকেন, উৎপাদন পরবর্তী শস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সে ধরনের সহায়তা কিম্বা প্রণোদনার উদ্যোগ নেয়া হয় না। ফলে চাষীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষাবাদ করলেও ক্ষতির মুখে পড়ে। কোনভাবেই এ অবস্থা কৃষির সমৃদ্ধির জন্য অনুকুল নয়। এমতাবস্থায় যা জরুরি, তা হচ্ছে, প্রতি বছর জাতীয় বাজেটে সবজি সংরক্ষণ উপযোগী হিমাগার সরকারি ভাবে নির্মাণের জন্য থোক বরাদ্দ রাখতে হবে। পর্যায়ক্রমে সবজি উৎপাদন অঞ্চলে ছোট বড় হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। তাহলে চাষীরা টমেটো, শিম, করলা, বেগুন, কুমড়া, লাউসহ অন্যান্য সবজি স্বল্প ভাড়ায় হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারবেন। যা চাহিদা অনুযায়ী হিমাগার হতে উত্তোলন করে দেশীয় চাহিদা পূরণের পর বাড়তি সবজি প্রয়োজনে বিদেশে রফতানিও করতে পারবেন। সরকার নিকট ভবিষ্যতে কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, এটাই চাষীদের প্রত্যাশা। সরকার চাষীদের ভাগ্য পরিবর্তনে সময়োপযোগী পৃষ্ঠপোষকতা দিলে বর্গাচাষী, প্রান্তিক চাষী, নদী চাষী সহ সকল চাষীর উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য যেমন একদিকে নিশ্চিত হবে, অন্য দিকে কৃষি খাতের সমৃদ্ধিও আরো বিকশিত হবে।

Powered by