ঢাকা

বিআরটিসির আউটসোর্সিং কারিগর’রা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেও অবহেলিত

  প্রতিনিধি ৩ মে ২০২৩ , ৬:৩৭:২৬ প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম বাবুল

ভালো নেই বিআরটিসি’র আউটসোর্সিং কারিগর’রা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনের পর দিন নিরলস শ্রম দিয়ে বিআরটিসির উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও এদের বিপদে-আপদে পাশে থাকছেনা সংস্থাটি। সীমিত বেতনে কোনো রকম চলে এদের সংসার। বছরের পর বছর কর্পোরেশনে কাজ করে এদের বেতনের কোন পরিবর্তন হয়না। এদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হলেও কোন ওভার টাইম দেওয়া হয়না। বছরের বিভিন্ন উৎসবে এদের বোনাস ও দেওয়া হয় না। সাপ্তাহিক ছুটিও নেই এদের। অসুস্থ হলে নেই চিকিৎসা সেবা। কর্মক্ষেত্রে আহত হলেও জোটেনা চিকিৎসা সহায়তা। এমনকি আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকলেও মিলে না ছুটি। উপরন্ত অনুপস্থিত দেখিয়ে বেতন থেকে টাকা কর্তনের কথা বললেন আউটসোর্সিং কারিগররা। দৈনিক দশ থেকে বারো ঘন্টা কাজ করে মাস শেষে যে বেতন পান তা দিয়ে ঠিকমতো সংসার চলেনা তাঁদের। গ্রেড ভেদে নয় হাজার পাঁচশ থেকে পনের হাজার ছয়শ টাকা বেতনে কাজ করেন এসব কারিগররা। এদের দিয়ে কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করানো হলেও ছিটে ফোটা সুবিধা দেওয়া হয়না অভিযোগ অনেক কারিগরের।

অতিরিক্ত কাজের জন্য কোন প্রকার সুবিধা পান না আউটসোর্সিং কারিগররা। এরা যুগ যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছেন কিন্তু স্থায়ী করার কোন উদ্যোগ নেই কর্পোরেশনের। বিভিন্ন সময়ে কারিগর নিয়োগে আউটসোর্সিং কারিগররা অংশগ্রহন করলেও তাদেরকে নিয়োগ দেয় হয় না। এমনকি নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও ঘুষ ছাড়া চাকরি না হওয়ার কথা বললেন বেশ কয়েকজন আউটসোর্সিং কারিগর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ সকল কারিগররা বলেন, হাতে গোনা কয়েকজন আউটসোর্সিং কারিগরের চাকরি হয়েছে তাও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। এছাড়া শারীরিক প্রতিবন্ধি কারিগরের ও প্রতিবন্ধি কোটায় চাকরি হয়নি।

প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে ওই কারিগররা আরো বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে করতে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আবার অনেকে অঙ্গহানির পাশাপাশি কর্মক্ষম ও হন। কিন্তু তাদের কোনরূপ ছুটি, চিকিৎসা সেবা বা চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়না। দীর্ঘদিন কাজ করা এ সকল আউটসোর্সিং কারিগরদের দাবি কর্পোরেশনে নিয়মিত কর্মচারী হওয়ার।

সরেজমিনে মতিঝিল ডিপোতে কথা হয় হাতে ব্যান্ডেস মোড়ানো এক কারিগরের সাথে। হাতে ব্যান্ডেসের কারণ জানতে চাইলে রনি ঢালী নামের এ কারিগর বলেন, শবে কদর রাতে সেহরির সময় রাস্তায় নষ্ট হওয়া গাড়ী মেরামতের মালামাল উঠাতে গিয়ে বাম হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল ভেঙ্গে গেছে। ভাংগা আঙুল নিয়ে ডিপোতে আসছেন? সরল জবাব-হাজিরা না দিলে বেতন থেকে টাকা কর্তন করা হয়। এমনিতে যে বেতন পাই তা দিয়ে সংসার চলেনা। তাই অসুস্থ শরীর নিয়ে হাজিরা দিতে এসেছি। আঙ্গুল ভাংগার পর কর্পোরেশন থেকে কোন প্রকার সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা? এমন প্রশ্নে এ কারিগর বলেন, ম্যানেজার স্যার ৫০০ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া আর কোন সহযোগিতা পাইনি।

ডিপোর বাইরে রাস্তায় কথা হয় বডি মিস্ত্রি শফিকুল ইসলামের সাথে, বাম চোখে ঠিকমতো দেখতে পাননা এ কারিগর। সূর্যের আলোতে ঠিকমতো তাকাতেও পারেন না। চোখের সমস্যার কথা জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, বিআরটিসিতে বডি মিস্ত্রি হিসেবে বাইশ বছর কাজ করি, ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করতে গিয়ে বাম চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, চোখ ভালো হয়নি। এখন টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছিনা। কর্পোরেশন থেকে কোন প্রকার সহায়তা পেয়েছেন কিনা? জবাবে-কোন সহায়তা না পাওয়ার কথা জানালেন। চোখে সমস্যা নিয়ে কাজ করেন কিভাবে? এমন প্রশ্নে এ কারিগর বলেন, এক চোখ দিয়ে কাজ করতে কষ্ট হয়, কিন্তু করব কি? সংসার তো চালাতে হবে। এখান থেকে যা পাই তা দিয়ে কোনো রকম ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেঁচে আছি। তাছাড়া জীবন যৌবন কাঁটিয়ে দিয়েছি এই বিআরটিসিতে এখন যাব কই? সামনে যদি কর্তৃপক্ষ দয়া করে বিআরটিসির নিয়মিত কর্মচারী করে নেয় সে আশা নিয়ে বেঁচে আছি।

বডি মিস্ত্রি শফিকুল ইসলামের সাথে কথা বলার সময় বাক প্রতিবন্ধি এক কারিগর এসে হাত-পা দেখিয়ে কি যেন বুঝাতে চাচ্ছেন। পাশে থাকা আরেক কারিগর বললেন, উনি বোবা কথা বলতে পারেন না। কিছুদিন আগে এক এক্সিডেন্টে উনার ডান পায়ের একটা রগ কেটে গেছে এবং হাতের কবজিতে ভিষণ আঘাত পেয়েতে। ওই হাতে তেমন কাজ ও করতে পারেন না। আপনাকে ইশারার মাধ্যমে তাই দেখাতে চাচ্ছে। জানা গেল, বাক প্রতিবন্ধি এ কারিগরের নাম মোকছেদ আলী। দুর্ঘটনার পর তিনিও কোন সহায়তা পাননি। পাননি চিকিৎসা সেবা। দুর্ঘটনার সময় তাকে ২ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল তাও পরে বেতন থেকে কেটে নেওয়ার কথা বললেন পাশের এক কারিগর। বাকপ্রতিবন্ধি এ কারিগরের পরিবারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার স্ত্রীও বাকপ্রতিবন্ধি। তাদের দুটো কন্যা সন্তান রয়েছে। সন্তানেরা মাদ্রাসায় পড়ে। মোকসেদ আলী কর্পোরেশন থেকে যা পান এবং তাঁর বৃদ্ধা মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পান তাই দিয়ে কোনো রকম তাঁদের সংসার চলে।

২০০৬ সাল থেকে বিআরটিসির আউটসোর্সিং কারিগর হিসেবে কাজ করে আসছেন মো. জামশেদ ভূঁইয়া। ২০০৯ সালে চট্রগ্রাম বাস ডিপোতে কর্মরত থাকা অবস্থায় গাড়ীর নিচে ইঞ্জিনের কাজ করতে গিয়ে গাড়ীর চাকা তাঁর পায়ের উপর দিয়ে উঠে যায়। এতে তার বাম পায়ের মাংস ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যায়। চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে তিনি আবার কাজে যোগ দেন। তবে চিকিৎসার জন্য কোন প্রকার সহায়তা না পাওয়ার কথা জানালেন। আলাপচারিতায় জানা গেল, তিনি জোয়ার সাহারা বাস ডিপোর কোরিয়ান দাইয়ো গাড়ীর ইঞ্জিন মেরামতের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিআরটিসির কারিগর নিয়োগ পরীক্ষায় কয়েকবার অংশগ্রহন করেও চাকরি হয়নি এ দক্ষ কারিগরের।

মুঠোফোনে কথা হয় দুর্ঘটনায় এক পা হারানো বরিশাল ডিপোর আউটসোর্সিং কারিগর নজির আহমেদ কবিরের সাথে। ভোরের দর্পণকে তিনি বলেন, দুই যুগের বেশি সময় ধরে বিআরটিসিতে কাজ করছেন। ২০০০ সালে বিআরটিসির গাড়ীতে ডিউটি পালনকালে তার ডান পায়ের উপর দিয়ে গাড়ীর চাকা উঠে যায় এবং ওই পায়ের হাটুর নিচের অংশ কেটে ফেলা হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে আবার ২০০২ সালে বিআরটিসিতে যোগ দেন এবং আজ অবদি তিনি কাজ করে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখতেন বিআরটিসির নিয়মিত কর্মচারী হওয়ার। তা আর সম্ভব হয়নি। এখন আর চাকরির বয়স নেই, দুই ছেলেকে বিআরটিসির চাকরির জন্য চেষ্টা করেছেন তাও হয়নি। পা হারানো এ কারিগরের আফসোস নিজে তো নিয়মিত স্টাফ হতে পারলাম না, একটা ছেলের ও যদি বিআরটিসিতে চাকরি হতো তাহলে দুর্ঘটনায় পা হারানোর দুঃস্বপ্ন কিছুটা হলেও ভুলতে পারতাম।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by