বাংলাদেশ

বিডিআর বিদ্রোহ: নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর

  প্রতিনিধি ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ , ৭:১৪:১২ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক :

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সকালটা শুরু হয়েছিল বার্ষিক বিশেষ আয়োজন দিয়ে। তবে শেষ হলো রক্ত, লাশ আর বারুদের গন্ধে। সেদিন পিলখানায় বিডিআরের (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহী জওয়ানেরা নৃশংসভাবে হত্যা করেন ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। হত্যাযজ্ঞ আর বীভৎসতায় বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি।

আজ রোববার সেই মর্মন্তুদ ঘটনার ১৪ বছর। এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তাণ্ডব চালায়।

নিহতদের তালিকায় ছিলেন তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল। এছাড়া সামরিক কর্মকর্তা ছাড়াও বিডিআরের গুলিতে কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হন। সদরদপ্তরের ভেতর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তবে বিদ্রোহীরা ভেতরে আটকে পড়া শিশু ও নারীদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।

২৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে তাৎক্ষণিক এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে বিডিআর সদস্যদের একাংশ আত্মসমর্পণ করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত বিডিআর ক্যাম্পে পুনরায় উত্তেজনার খবর পাওয়া যায়। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিডিআরকে আবারও তাদের দাবি দাওয়া মেনে নেয়ার আশ্বাস দেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বিদ্রোহী বিডিআরের সকল সদস্য তাদের অস্ত্র জমা দেন এবং পুলিশ বিডিআর সদরদপ্তর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।
সেদিন যা ঘটেছিল : বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছেন। হঠাৎ মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান ওপরে উঠে আসেন, এঁদের একজনের হাতে অস্ত্র। মহাপরিচালকের দিকে তাক করে ধরেন সেই অস্ত্র। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে এভাবে শুরু হয় পিলখানার বিডিআর বিদ্রোহ। ৩৩ ঘণ্টার এই বিদ্রোহ শেষ হয় ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৬টায়। এই সময়ের মধ্যে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে অসহায়ের মতো প্রাণ দিতে হয়।

সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও মামলার নথি থেকে জানা যায়, ওই দিন বিডিআরের বার্ষিক দরবারে উপস্থিত ছিলেন বাহিনীর কর্মকর্তা ও নানা পদের সদস্যসহ ২ হাজার ৫৬০ জন। সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে দুই জওয়ানের মঞ্চে আসার পরপরই দরবার হলের বাইরের দিক থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানেরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। ডিজি প্রধানমন্ত্রী, সেনাপ্রধানসহ অন্যদের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে দ্রুত সেনা হস্তক্ষেপের অনুরোধ জানান।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। এরপর পিলখানার ভেতরে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়।

আলোচনার মাধ্যমে বিদ্রোহীদের নিরস্ত্রীকরণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বেলা দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদা পতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।

তবে সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানেরা। তাঁরা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।

হাইকোর্টে মামলার রায়: ১৫ জনের মৃত্যুর কারণে উচ্চ আদালতে মোট ৮৩৫ আসামীর শুনানি শুরু হয়।৩৭০ কার্য দিবস শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭শে নভেম্বর রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। সেখানে মোট ৫৫২ জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। খালাস দেয়া হয় ২৮৩ জনকে। নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামীর মধ্যে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট। ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন প্রদান করা হয় এবং ৫ জন খালাস পান।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম এত বেশি সংখ্যক আসামির সাজা হাইকোর্টে অনুমোদন হয়। নিম্ন আদালতে ১৬০ জন যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামীর মধ্যে হাইকোর্ট ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখে এবং ১৪ জনকে খালাস দেয়। তবে নিম্ন আদালতে যাদেরকে খালাস দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ৬৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে হাইকোর্ট ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
৪ জনকে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং ৩৪ জনের খালাস আদেশ বহাল রাখে। সে হিসেবে হাইকোর্টে মোট যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। এছাড়া ২২৮ জনকে ১৩ থেকে ১ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বিস্ফোরক মামলা ঝুলে আছে : নৃশংস ওই হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়, যা পরে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। 

১৪ বছর আগে পিলখানায় তৎকালীন বর্ডার গার্ড (বিডিআর) বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহতের ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলাটির আপিল এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

একই ঘটনায় দায়ের হওয়া বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়নি বিচারিক আদালতে। বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাদের মধ্যে ৩৩ আসামি ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং ২০ আসামি পলাতক। ৭৮১ আসামি কারাগারে আছেন। হত্যা মামলার আসামিরাই এই মামলায় আসামি।

বিস্ফোরক মামলাটি নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্ব শেষ হয়ে রায় প্রদানে আরও কয়েক বছর লেগে যেতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাসে। 

বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে নানা মহলের রয়েছে নানা প্রশ্ন, অনেকেই মনে করেন এর পিছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। অবশ্য রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এসেছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা ক্ষমতা আসার মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। তাদের সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে বিদ্রোহ দমনে সরাসরি সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করায় বিরোধী দল বিএনপি শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিল। তাদের অনেকে সে সময় এই ঘটনার জন্য প্রতিবেশী ভারতের দিকেও আঙ্গুল তুলেছিলেন।

বিডিআর বিদ্রোহের ১৪ বছর পার হলেও এখন মানুষের মনে এ নিয়ে রয়েছে গুপ্ত কৌতূহল।  আর ৫৭ সেনা কর্মকর্তার পরিবারে বইছে অতিপ্ত রক্তক্ষরণ।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by