উপ-সম্পাদকীয়

রোগ প্রতিরোধের শক্তি বাড়াও

  প্রতিনিধি ২ এপ্রিল ২০২০ , ২:১১:০২ প্রিন্ট সংস্করণ

আতাউর রহমান মিটন :অনেক ভেবেও করোনা প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কিছু লেখা সম্ভব হচ্ছে না। সব মহল থেকে বারবার করে বলা হচ্ছে ‘আতঙ্কিত হবেন না’, তবু চারিদিকে সংবাদ আর আলোচনাগুলো আতঙ্কময়। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক আমরা সবাই আতঙ্ক ছড়াচ্ছি। আতঙ্কের কারণেই বগুড়ার শিবগঞ্জে করোনার ন্যায় লক্ষণ নিয়ে মৃত ব্যক্তির দাফন নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা ঢাকাতেও। আতঙ্কের কারণে ব্যাহত হচ্ছে অন্যান্য সকল ধরণের চিকিৎসাসেবা। পত্রিকায় দেখলাম, করোনা সংকটের কারণেই জার্মানীতে টমাস শেফার নামে এক মন্ত্রী চলন্ত ট্রেনের নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। এর বাইরে ঘরে ঘরে বন্দি থাকা মানুষগুলো, বিশেষ করে শিশুরা যে কি ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তা আমরা জানি না। একটা ভয়ঙ্কর অমানবিক পরিস্থিতিতে আজ বিশ্ববাসী! এভাবে আর কতদিন? এর শেষই বা কোথায়?
পৃথিবীতে এটাই প্রথম মহামারী নয়। আর শুধু করোনাতেই মানুষ মারা যায় না। বিশ্বব্যাপী নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের শিকার হয়ে আগেও বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মানুষ তখন এত আতঙ্কিত হয়নি, এখন যতটা হচ্ছে। এর একটা কারণ বোধকরি গণমাধ্যমের সরব প্রচারণা। আপনি দেশি বা বিদেশী এমন কোন গণমাধ্যম পাবেন না যার সিংহভাগ সময় করোনা বিষয়কে নিয়ে কাটছে না। বিনোদন চ্যানেলগুলিও এর ব্যতিক্রম নয়। আমি বলছি না বিশ্ব পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং এখন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াব। না, এটা মোটেও বাঁশি বাজানোর সময় নয়। এখন সময় সতর্কতার। এখন সময় ঘুরে দাঁড়ানোর এবং নিজেদের ভুলগুলো শোধরানোর। আমাদের জানা, বোঝা ও শেখার এখনও অনেক কিছু বাকি। আসুন আমরা সচেতন হই, আমরা বিজ্ঞানমনস্ক হই, আমরা নিজেদের চিন্তাশক্তিকে জাগ্রত করি এবং বিবেকের দ্বারা পরিচালিত হই। আসুন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের নির্দেশনা মেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করি। পাশাপাশি আমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করি, সকলের খোঁজ খবর রাখি এবং সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়াই।
করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নি¤œআয়ের মানুষেরা। যারা চাকরি করেন না, যাদের মাস শেষে সুনির্দিষ্ট মাইনের সুবন্দোবস্ত নেই, সেই মানুষগুলো এখন বড্ড অসহায়। তাদের অনেকেই আছেন যারা হাত পেতে মানুষের কাছে সাহায্যও চাইতে পারছেন না। এই দুঃসময়ে মানুষের মনে ভরসা জাগাতে হবে। মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাঁরা নিজেদের ‘জনদরদী’ পরিচয় দিয়ে সুযোগ পেলেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে পোষ্টার-ফেষ্টুন ঝুলিয়ে দেন, যাঁরা বিপদে-আপদে ভোটারদের পাশে থাকবেন বলে উঁচু গলায় ওয়াদা করেন তাঁরা এখন তৎপর হোন, নিজেদের ‘জনদরদী’ প্রমাণ করুন। এই পরিস্থিতিতে আপনার এলাকার অসহায় মানুষদের খোঁজখবর নিন এবং তাদের পাশে দাঁড়ান। সরকার ভুক্তভোগী মানুষদের খাদ্য ও চিকিৎসা নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে সুবিধাগুলো ঘোষণা করেছেন, তা শিবচরের সরকারি দলের যুবনেতার মত মেরে না দিয়ে মানুষের মাঝে সুষ্ঠুভাবে বিতরণে সহযোগিতা করুন। দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ান। প্রমাণ করুন আপনি সত্যিকার অর্থেই ‘জনদরদী’। মনে রাখবেন, বিপদেই বন্ধু’র পরিচয়। আজ এই বিপদে যাঁরা পাশে থাকবেন, সহযোগিতার হাত বাড়াবেন তাঁরাই আমার বিবেচনায় সত্যিকারের বন্ধু, সত্যিকারের ‘জনদরদী’। অবশ্য একদল সুযোগ সন্ধানী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্যামেরা ট্রায়াল হিসেবে দানের হাত বাড়িয়ে দিবেন, এই সুযোগে নিজেকে ‘দানবীর’ প্রমাণের চেষ্টা করবেন। তাঁদের ব্যাপারেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। এরা প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগায় নিজেদের স্বার্থে, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে। আমার কাছে মনে হয় এরাও ‘ভাইরাস’, এদের থেকেও আমাদের দুরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন।
মানুষ মাত্রই মানবিক হবেন এটাই স্বাভাবিক। পৃথিবীতে মানুষ তাঁরা মেধা ও কর্মপ্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধ্য সাধন করেছে এবং অতীতের অনেক মহামারি মোকাবেলা করেছে। ভাইরাস অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। তার মধ্যেও মানুষ টিকে থাকবে কারণ সে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। মানুষ তার মেধা খাটিয়ে এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমর্থ হবে এটা আমার বিশ্বাস। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষকে এই পরিস্থিতি থেকে কিছু শিক্ষা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। কিছু প্রশ্ন নিজের মধ্যে তৈরি করতে হবে। উত্তর যদি এখন পাওয়া নাও যায় তাহলেও প্রশ্নটা রাখতে হবে। যেমন, কেন শীত প্রধান অঞ্চলগুলোতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের তুলনায় বেশি? কেন খেটে খাওয়া ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে এই সংক্রমণের হার কম? কেন বয়স্করা এই ভাইরাসের দ্বারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ? ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি জীবাণূ কোথায় বাস করে এবং কিভাবে ছড়ায়? খাবার কিভাবে একই সাথে রোগের কারণ এবং রোগের প্রতিকার হয়? রোগের চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধ এর মধ্যে পার্থক্য কী? প্রতিরোধ যদি চিকিৎসার চেয়ে উত্তম হয় তাহলে প্রতিরোধের উপায়সমূহ কী কী? মহামারি বা এ ধরনের দুর্যোগ কাজে লাগিয়ে কারা ব্যবসার বিস্তার করে এবং নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির ফন্দি আঁটে? গুজব ছড়ালে কাদের বেশি সুবিধা হয়, লাভের গুড় কারা খায়? এরা কারা? এই ধরনের প্রশ্নগুলো নিজেদের মধ্যে যত বেশি বেশি করতে পারবেন এবং একটা নিরপেক্ষ উত্তর পাবার চেষ্টা করবেন, দেখবেন অনেক কিছুই নিজেদের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য নিয়ে রাজনীতি যেমন হয়, একটি গোষ্ঠী যেমন করে খাদ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, তেমনি চিকিৎসা নিয়েও কি রাজনীতি হয় না? তেমনি একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী কি মানুষের চিকিৎসা নিয়েও বাণিজ্য করে না? নিজের মধ্যে এমনি প্রশ্নগুলো তৈরী করুন। আমার তরুণ বন্ধুদের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ, ভবিষ্যতটা তোমাদের তাই তোমার এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসো, নিজেদের মধ্যে চিন্তাশীলতা জাগাও। তোমরা ভয়ে দূরে সরে থেকো না। মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে রেখো। বহু সন্তানই তখন বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে মাটি ও মানুষের কল্যাণে আত্মাহুতি দেবার প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তারা সেদিন অবাধ্য হয়েছিল জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে। সেদিন তারা আত্মাহুতি দিয়েছিল বলেই আজ আমরা স্বাধীন। তোমরা ভেবে নাও জাতির এই দুর্যোগকালে তোমাদের করণীয় কী? তোমরা প্রস্তুত হও এক নতুন যুদ্ধের জন্য। নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য তোমরা তৈরী হও। তোমাদের আত্মদানেই গড়ে উঠুক এক সুন্দর আগামী।
শুধু করোনাভাইরাস নয়, অন্যান্য সকল অসুখ থেকে দূরে থাকার জন্যেও আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি, সেই তত সুরক্ষিত। আমাদের তরুণ বন্ধুদেরকে চিন্তাশীল হতে হবে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গবেষণায় এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দেশের মানুষরা সৃজনশীল কিন্তু তাদের সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ নাই। তরুণদের চিন্তাগুলোকে ডানা মেলে আকাশে ওড়াতে হবে। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। এই করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য পৃথিবীতে গবেষণা শুরু হয়েছে অথচ দেখ আমরা সময় কাটাচ্ছি অলসতায়! আমরা হয়তো টিকা আবিষ্কারের গবেষণা করতে পারব না কিন্তু বইয়ের পাতা ঘেটে মানুষকে রোগ প্রতিরোধের উপায় তো শেখাতে পারব, তাই না? অথচ দেখো, সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আমরা কেবল গৃহবন্দি হইনি, আমরা অনেকেই অলস ও স্থবির হয়ে পড়েছি। আমাদের চিন্তাগুলো শরীরের কোষগুলোর মতই স্থবির হয়ে যাচ্ছে। এই বন্দি সময়ে শরীর চাঙ্গা রাখতে যেমন ব্যায়াম দরকার তেমনি নিজেদের মেধা বিকাশের জন্যেও মনের ব্যায়াম করা দরকার। এটা জুয়া বা তাস খেলে কাটানোর উপযুক্ত সময় নয়। এটা জেগে থাকার সময়, অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জাতির পাশে এসে দাঁড়ানোর সময়। তোমার চিন্তা করো, কিভাবে নিজেদের পরিবার ও প্রতিবেশিদের সুরক্ষা দেয়া যায়? এর জন্য এখনই কি করা দরকার? এর জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কি করা প্রয়োজন?
পৃথিবীতে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদি সব সময়ই থাকবে। অন্যদিকে, মহান সৃষ্টা তাঁর সৃষ্টিলগ্নেই মানবজাতির সুরক্ষার জন্য অনেক উপায় দিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমরা কি জানি কিভাবে নিজেদের সুরক্ষা করতে হয়? আমরা কি জানি প্রকৃতির সেই মহান উপাদানগুলো কি যা আমাদের সুরক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর? যেমন ধরুন নিম গাছ। কথায় আছে, ‘নিম গাছের হাওয়া, লক্ষ টাকার দাওয়া’! আচ্ছা এটা কি মিথ্যা? যদি মিথ্যা না হয় তাহলে আমাদের দেশে নিম গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে কেন? নিজেদের প্রশ্ন করি নিজে কয়টা নিম গাছ আমরা এই জীবনে লাগিয়েছি? কেন লাগাও নি? তুমি কি জানো নিম গাছ প্রকৃতি থেকে রোগ জীবাণু শুষে নেয়?
আমরা কি জানি কালোজিরা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কতখানি জাদুকরী ভূমিকা রাখে? তাহলে আমরা কালোজিরা খাই না কেন? আমরা কেন অন্যকেও বেশি করে কালোজিরা খেতে বলি না? আমরা কি জানি আমাদের বাসক, শিউলি ফুল, পুদিনা, নিশিন্দা, আদা, রসুন, লেবু, আমলকি, হরিতকি, বহেড়া ইত্যাদি দেশজ গাছ-গাছালি আমাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষা ও রোগ প্রতিরোধে কিভাবে অবদান রাখে? জানতে সমস্যা কোথায়? আমাদের বেশি বেশি জানার চেষ্টা করতে হবে।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের সামাজিক শক্তিকে সম্মিলিত করতে হবে। এটা কোন ব্যক্তির বা দলের একার লড়াই নয়। এই লড়াই আমাদের সকলের, এটা মানবতার। করোনা নিয়ে কথা উঠলেই সবাই ভয় ছড়ায়, মানুষকে ভয় দেখায়। যে মানুষ নিজেই ভীতু তার পক্ষে অন্যকে সাহস দেয়া কঠিন। পৃথিবীতে সামান্য কিছু মানুষ আছেন যারা এখনও ভরসা রাখেন এবং আশার বাণী শোনান। তাঁদেরই একজন ২০১৩ সালে রসায়ন শাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জীবপদার্থ বিজ্ঞানী মাইকেল লেভিট, যিনি দাবী করেছেন ‘মানবসভ্যতাকে আতঙ্কে ফেলে দেওয়া করোনা ভাইরাসের প্রভাব ধীরে ধীরে কমে আসছে। দ্রুত এই মহামারী সমাপ্তির সন্নিকটে পৌঁছাচ্ছে’। লেভিট আরও দাবি করেন, বেশির ভাগ ব্যক্তির শরীরে কভিড-১৯ প্রতিরোধের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা রয়েছে। আমি বিজ্ঞানী লেভিট এর কথায় আস্থা রাখছি।
আমাদের সরকার তথা আইইডিসিআর ঘোষিত নিয়ম  আমরা সবাই মেনে চলি, মনযোগ বাড়াই নিজেদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে। মনের শক্তি বাড়াই। মনোবলের শক্তির চেয়ে বড় কিছু নেই। অসংখ্য সিনেমা, নাটক, গল্প, উপন্যাস ও ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা মনোবলের শক্তির সাফল্য সম্পর্কে জানতে পারব। এমনকি নিজেদের জীবনেও লক্ষ্য করলে দেখব, আমরা সেখানেই জয়ী হয়েছি যেখানে আমাদের মনোবল দৃঢ় ছিল। আসুন, আমরা নিজেদের চিন্তাশীলতাকে জাগ্রত করি। নিজেরা আত্মশক্তিতে বলীয়ান হই। করোনা আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রতিরোধ করার শক্তিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। সেখানে কোন অবহেলা নয়!

আরও খবর

Sponsered content

Powered by