খুলনা

সন্তানের কাছে আশ্রয় হয়নি, অন্যের ছাগলের খুপড়িতে ভিক্ষাবৃত্তিতেই জীবন চলে মনোয়ারার

  প্রতিনিধি ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ , ৫:০১:০৩ প্রিন্ট সংস্করণ

তালা (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি:

ষাটোর্ধ মনোয়ারা বেগমের এখন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ভিক্ষাবৃত্তি। বাড়ি সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বারুইহাটি গ্রামে। বসবাস করছেন দেবরের ছাগলের খোয়াড়ে। বছর তিনেক হল স্বামী ফরিদ উদ্দীন খাঁ’র মৃত্যু হয়েছে দুরারোগ্য ক্যান্সারে। একমাত্র ছেলে কাঠ ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৮) প্রায় ১৫ বছর আগে বিয়ে করে শ্বশুরের জায়গায় বাড়ি করে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছে। স্বামীর মৃত্যুর পর মনোয়ারার ছেলের বাড়িতে আশ্রয় হলেও মাস ছ’য়েকের মধ্যে সেখান থেকেও ফিরে আসতে বাধ্য হন। এখন প্রতিবেশী এক দেবরের ছাগলের খোয়াড়ে ছাগলদের সাথে ঘর শেয়ার করে রাত্রি যাপন করলেও অসুস্থ্য শরীরে ভিক্ষাবৃত্তিতেই চলে তার জীবিকা। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছে তার করুণ আর্তি মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, বাকি জীবন কাটাতে দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে দিন।

প্রায় আড়াই বছর ধরে প্রতিবেশী এক দেবরের ছাগল রাখার ছোট্ট খুপড়ির একপাশে ছাগল আর অন্যপাশে মনোয়ারার থাকার সাময়িক বন্দোবস্ত হলেও কারো প্রতি আক্ষেপ নেই তার। তবে অসুস্থ্য শরীরে প্রতিদিন পরের বাড়িতে গিয়ে হাত পেতে ভিক্ষা নিতেই যত কষ্ঠ তার। এর জন্যও ছেলে-বউ’র প্রতি ক্ষোভ নেই তার। জীবনে পড়ন্ত বেলায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি তার দাবি, আমাকে দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের বন্দোবস্ত করে দিন।

মনোয়ারা জানান, একমাত্র ছেলে কাঠ ব্যবসায়ী প্রায় ১৫ বছর আগে একই গ্রামের নাংলা মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাও: আঃ মালেকর মেয়ে আয়শাকে বিয়ে করে সেই থেকে শ্বশুরের জায়গায় বাড়ি-ঘর করে সেখানেই বসবাস করে। স্বামীর মৃত্যুর পরে ছেলের বাড়িতে আশ্রায় নেন তবে, স্থায়ী হয়নি। নিয়তির নির্মম পরিহাসে মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ছেলে-বৌ’র মানসিক অত্যাচারে একমাত্র আশ্রয় ছাড়তেও বাধ্য হন তিনি। জীবন-জীবিকার তাগিদে ভিক্ষাবৃত্তি করে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটলেও অসুস্থ্য মনোয়ারা ফিরতে চাননা ছেলের ঠিকানায়।

মনোয়ারা জানান, ৩ বছর আগে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় স্বামী মোঃ ফরিদউদ্দিন খাঁর। স্বামীর মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া সমুদয় সম্পত্তি বৃদ্ধা মাকে দেখভালের মিথ্যা আশ্বাসে বিক্রি করে দেন একমাত্র ছেলে। তার আক্ষেপ স্বামীর সম্পত্তি বিক্রির টাকায়ও যখন ছেলের আশ্রয়ে ঠাঁই হয়নি তার তখন, মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের আর দরকার নেই তার। যতদিন বেঁচে আছেন, পরের খোয়াড়ে দু’বেলা খাবারের বন্দোবস্ত হলেই হল। তবে সেটা ছেলের পয়সায় হোক সেটা চাননা তিনি।

মনোয়ারা বেগমের অসহায় যাপিত জীবনের খবরে সরেজমিন গেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, দশ মাস গর্ভেধারণ করে যে সন্তানকে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখালাম, কষ্ঠ করে বড় করলাম সেই সন্তানই যখন আমার হলনা তখন মাথা গোঁজার জন্য কোন আশ্রয় আর আমার চাইনা। শুধু খাবারের যোগান হলেই একটু শান্তিতে থাকব। কেননা, এখন আর আগের মত শরীর চলেনা। নানা রোগ-শোকে মূহ্যমান মনোয়ারার দাবি, শুধু দু’বেলা দু’মুঠো খাবার দিলেই জীবনে আর কিছুই চাইনা তার।

সরকারের দেয়া উপহারের আশ্রায়ন প্রকল্পের কোন ঘরের বন্দোবস্ত চান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবেও তার সাফ কথা, ছাগলের ঘরে থাকতে তার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তার। শুধু দরকার খাবারের।

এসময় তিনি আরো বলেন, আমি খুব অসুস্থ, ডায়বেটিস, বাত ব্যাথাসহ শারীরিক নানা রকম অসুখ বাসা বেঁধেছে। সরকার কিংবা সমাজের কোন সহৃদয়বান মানুষের দয়া হলে সামান্য ওষুধ আর দু’বেলা খাবার চান তিনি।

সরকারি কোন সহয়াতা পান কিনা জানতে চাইলে বলেন, বিধবা ভাতার পয়সায় কিছু দিন ভাল থাকেন। তবে ভাতার টাকাও নাকি ঠিকমত পাননা তিনি। এনিয়ে সমাজসেবা অফিসে খোঁজ নিতে গেলেও নাকি তারা তিরষ্কার করে বের কওে দেন তাকে।

স্থানীয় প্রতিবেশীরা জানান, ছেলের বিয়ের আগে তাকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন মনোয়ারা। তবে বিয়ের পর থেকে শ্বশুরের জায়গায় বউয়ের আঁচলবন্দি হয়ে পড়ে একমাত্র সন্তান। এরপর স্বামীর মৃত্যুর পর সত্যিই একা অসহায় পড়েছেন তিনি। এমনকি স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিটুকু বিক্রি করেও ছেলেকে দিয়েছেন ভরসা ও মিথ্যা আশ্বাসে।

তারা আরো বলেন, ব্যবসায়ী স্বচ্ছল সন্তানের বাড়ীতে যে গর্ভধারীনি মায়ের আশ্রায় হয় না , সন্তান থাকতেও যে মায়ের জীবন-জীবিকা চলে ভিক্ষাবৃত্তি করে। সেই সন্তানের শাস্তি কামনায় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করলেও সার্বক্ষণিক শান্তি কামনা করেন অসহায় বৃদ্ধা মা মনোয়ারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ পিতা-মাতার ভরণ পোষণের দায়িত্ব সন্তানের। যদি কোন সন্তান এই দায়িত্ব পালন না করলে তাকে দ:বি: ২০১৩-এর ৫ ধারার (১) আইন লঙ্ঘন করার অপরাধে এক লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত হতে পারে। শুধু তাই নয়, কোনো সন্তানের স্ত্রী, স্বামী, তাঁদের পুত্র-কন্যা কিংবা অন্য কোনো নিকটাত্মীয় যদি বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানকে ভরণ পোষণের দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় তাহলে উক্ত আইনের ধারা ৫(২) অনুযায়ী তারাও সমভাবে অপরাধী হবেন, ফলে তারাও একই শাস্তির মুখোমুখি হবেন।

এলাবাসী এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করলেও সন্তানের শাস্তি চাননা অসহায় মা মনোয়ারা। সন্তানের অবহেলা-অনাদরে আর কোন মা-বাবা যেন এমনভাবে ভিখারী না হন, সন্তান থাকতেও কারো যেন এমন পরিণতি না হয় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহনে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সদয় হবেন এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন এলাকাবাসীর।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by