বরিশাল

সীমাহীন দুর্নীতিতে বরিশাল বিআরটিসি ডিপো: কাওরাকান্দি রুটেই কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি

  প্রতিনিধি ১৮ আগস্ট ২০২১ , ৮:২৮:৫০ প্রিন্ট সংস্করণ

এস এম বাবুল:

বরিশাল-কাওরাকান্দি রুটে চলাচলকারি বিআরটিসি’র এসিবাস থেকে আদায়কৃত প্রকৃত রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা না দিয়ে ডিপো কর্তৃক তৈরী ওয়েবিলে নির্দিষ্ট রাজস্ব (সেল) জমা দিয়ে ব্যাপক রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ আসছে বিআরটিসি বরিশাল ডিপোর বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান বরাবরে সম্প্রতি ওই রুটে চলাচলকারি এক যাত্রীর জনস্বার্থে দায়ের করা অভিযোগে বিআরটিসি বরিশাল ডিপোর কাওরাকান্দি-বরিশাল রুটের রাজস্ব চুরি ও অনিয়মের বিষয়টি ফুটে ওঠে।

ফেরদৌস আলম স্বাক্ষরিত ওই অভিযোগপত্রে জানা যায়, বরিশাল-কাওরাকান্দি রুটে দৈনিক ১৫টির অধিক ট্রিপ নিয়ে বিআরটিসি’র এসিবাস চলাচল করে। জনপ্রতি তিনশ টাকা ভাড়ায় প্রতিট্রিপে গড়ে আশির অধিক যাত্রী নিয়ে বাস চলাচল করলেও রাজস্ব জমা হয় ডিপো কর্তৃক নির্ধারিত চৌদ্দ হাজার টাকা। আবেদনের সাথে সংযুক্ত কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই রুটে প্রকৃত রাজস্ব আসে ট্রিপপ্রতি গড়ে চব্বিশ হাজার টাকা। হিসেব মতে, দৈনিক পনেরটি ট্রিপ থেকে সাড়ে তিন লাখের বেশি রাজস্ব জমার কথা থাকলেও জমা হচ্ছে মাত্র দুই লাখের কিছু বেশি অর্থাৎ দৈনিক রাজস্ব কম জমা হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। বরিশাল ডিপোর একাধিক চালকের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাউন্টার থেকে দেওয়া ওয়েবিলে রাজস্ব বুঝে নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ডিপো নির্ধারিত ওয়েবিলে।

রাজস্ব জমার বিষয় নিয়ে কথা হয় বরিশাল ডিপোর সাবেক ইউনিট প্রধান মনিরুজ্জামান বাবুর সাথে ভোরের দর্পণকে তিনি বলেন, বর্তমানে এ রুটে বাস চলাচল করে ৯টি তবে কোন কোন বাসের একাধিক ট্রিপ ও থাকে। প্রতিটি বাসের রাজস্ব জমা হয় ট্রিপপ্রতি চৌদ্দ হাজার টাকা। চালকদের কাছ থেকে বেশি রাজস্ব নিয়ে কম জমা দেওয়ার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ রুটে ট্রিপপ্রতি রাজস্ব চৌদ্দ হাজার টাকা নির্ধারিত। এর বেশি নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসেনা। তবে, রাজস্ব জমার পরিমাণ অতীতে আরো কম ছিল জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, ডিপোর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে রাজস্বের পরিমান ধাপে ধাপে তিনি বাড়িয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরিশাল ডিপো থেকে বাস ছেড়ে কাওরাকান্দি হয়ে আবার ডিপোতে পৌছালে বাসের চালকদের রাজস্ব (ভাড়ার টাকা) ডিপো ইউনিট প্রধান মনোনীত স্টাফদের কাছে চেকারের স্বাক্ষরকৃত কাউন্টারের ওয়েবিলসহ জমা দিতে হয় এবং ডিপো কর্তৃক তৈরী ওয়েবিলে চালকদের বাধ্যতামূলক স্বাক্ষর দিতে হয় জানালেন, নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চালক। ওই চালক আরো জানান, ডিপোর ওয়েবিলে স্বাক্ষর দিতে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে অন্যাত্র বদলীর হুমকিসহ হেনস্থা করা হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান বরাবরে জনস্বার্থে দায়ের করা অভিযোগে আরো জানা যায়, ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৬৪৩৫ নং বাসটি চেকারের স্বাক্ষর সংবলিত ওয়েবিল নিয়ে চালক আনোয়ার ৫৫ জন যাত্রী নিয়ে কাওরাকান্দি বাস টার্মিনালে পৌছায় এবং একই চালক ৪২ জন যাত্রী নিয়ে বরিশাল নথুল্লাবাদ বিআরটিসি বাস ডিপোতে পৌছায়ে ট্রিপের রাজস্ব কমিশন বাদে ছাব্বিশ হাজার তিনশ চল্লিশ টাকা ডিপো ম্যানেজারের পছন্দের লোক কারিগর মিজানুর রহমানের কাছে জমা দেন। কিন্তু অফিস ওয়েবিলে টাকা জমার পরিমাণ ছিল চৌদ্দ হাজার টাকা। বাসটির এক ট্রিপে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বার হাজার তিনশ চল্লিশ টাকা। ওই দিনের ১৫টি ট্রিপে রাজস্ব ৩ লাখ পঁচানব্বই হাজার একশ টাকা জমার কথা থাকলেও সরকারি কোষাগারে জমা দেখানো হয়েছে মাত্র ২ লাখ দশ হাজার টাকা। একদিনেই রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ পঁচাশি হাজার এক’শ। রাজস্ব জমার বিষয় কারিগর মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, চালকের থেকে যে টাকা আমরা নিই, সে টাকা ডিপো ম্যানেজারের কাছে জমা দিয়ে দেই। আলাদা ওয়েবিলের কথা জানতে চাইলে ডিপো ম্যানেজার সব জানেন বলে এড়িয়ে যান।

টিআই মশিউর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষর করা ডিপোর ওয়েবিলে চৌদ্দ হাজার টাকা নেয়ার সুপরিশের বিষয় জানতে চাওয়া হলে, তিনিও ম্যানেজারের নির্দেশের কথা জানালেন। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে দেখা যায়, সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখে ১৩টি এবং ২৫ তারিখে ১৭টি বাস চলাচল করে। ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৫৫২১ নং বাসের চালক হাফিজ এক ট্রিপের ৯৫ যাত্রীর ভাড়া বাবদ কারিগর মিজানুরের কাছে কমিশন বাদে ২৩ হাজার তিনশ এবং ২৫ তারিখের ঢাকা মেট্রো-গ-১৫-৭৩১৪ নং বাসের চালক রফিক-২ ট্রিপের মোট ৯২ যাত্রীর ভাড়া কমিশন বাদে ২৩ হাজার সত্তর টাকা একই ব্যক্তির কাছে জমা দেন। কিন্তু অফিস ওয়েবিলে টাকা জমা দেখা যায় ২৮ হাজার। ওই দুইদিনে ২টি বাস থেকে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ দাঁড়ায় পনের হাজার তিনশ সত্তর টাকা। তবে এ দু’দিনে ওই রুটে বাস চলাচল করছে ৩০টি এবং যাতে রাজস্ব ফাঁকির পরিমান ছিল ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৪৭০ টাকা। হিসেব মতে এ রুটে রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ গড়ে ৪৮ লাখ ৬১ হাজার তিনশ পঞ্চাশ টাকা যার পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে প্রায় ৬ কোটি টাকা।

বরিশাল বাস ডিপোর অনিয়ম ও কাওরাকান্দি রুটের রাজস্ব ফাঁকি নিয়ে জানতে ডিপো ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে, হেড অফিসের অনুমতি ব্যতীত কোন তথ্য দেওয়া যাবেনা বলে তিনি জানালেন।
অভিযোগের বিষয় জানতে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান তাইজুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অফিসের বাইরে আছেন আগামীকাল ফোনে যোগাযোগের কথা বলে সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করেন। ১৮ আগস্ট (বুধবার) ল্যান্ডফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে দপ্তর থেকে জানানো হয় তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছেন। আপনার ফোনের বিষয়টি স্যারকে জানানো হবে।

Powered by