প্রতিনিধি ১৮ জুন ২০২৪ , ৮:২০:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ
এবারও সরকারের বেঁধে দেওয়া দরে কাঁচা চামড়া বিক্রি হলো না। শুধু তাই নয়, আড়তদারদের সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানিদাতারা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের অর্ধেক দামও পাননি।
বাধ্য হয়ে অনেকে স্থানীয় মাদ্রাসা ও এতিমখানার লোকজনকে বিনা পয়সায় কোরবানির পশুর দিয়ে দিয়েছেন। আবার কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে কম দামে চামড়া কেনার পরও লোকসান গুনেছেন।
আড়তদাররা তাদের ইচ্ছেমতো দামে চামড়া কিনেছেন— খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। লালবাগের পোস্তায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর কাঁচা চামড়া বিক্রি হয়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। আর দেড় লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫৫০ টাকায়— যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে চার থেকে পাঁচগুণ কম। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, চামড়া বিক্রি করে তারা ন্যায্য দাম পাননি। তারা বলছেন, কোরবানি হওয়া গরুর কাঁচা চামড়ার দাম প্রতিটি গত বছরের তুলনায় ঢাকায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বাড়লেও নির্ধারিত দরের চেয়ে অন্তত ৩০০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে।
পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় ঈদের দিন সোমবার (১৭ জুন) বিকালে বড় ও মাঝারি আকারের গরুর কাঁচা চামড়া সর্বোচ্চ ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে বড় ও মাঝারি আকারের চামড়া ৭০০-৮৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। হাজারীবাগ এলাকায়ও একই দরে চামড়া বিক্রি হতে দেখা যায়।
অপরদিকে ছাগলের চামড়া কিনতে একেবারেই অনীহা দেখিয়েছেন আড়তদারেরা। একেকটি ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে সর্বোচ্চ ১০ টাকায়। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদারদের সিন্ডিকেট পুরো দেশের কাঁচা চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কেউ সরকার নির্ধারিত মূল্যে বর্গফুট হিসেবে চামড়া কিনছেন না। এতে করে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ পড়েছেন বিপাকে। অনেকে কেনা দরের চেয়েও ১০০ টাকা কমে আড়তদারের কাছে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে আড়তদাররা বলছেন, কিছু আনাড়ি মৌসুমি ব্যবসায়ী লোকসান গুনলেও বেশিরভাগ কাঁচা চামড়া বিক্রি করে লাভ করেছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সার্বিকভাবে এবার কাঁচা চামড়া কেনাবেচা ভালো হয়েছে। বেশিরভাগ মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে লাভবান হয়েছেন।
লবণের দাম তুলনামূলকভাবে এবার কম ছিল, এ কারণে সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও ভালো হয়েছে।তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের ও প্রশাসনের সার্বিক সহযোগিতায় ফড়িয়া, আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ী সবার জন্য ভালো হয়েছে।
সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, অনেকে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে ২০০ টাকায় কিনে আড়তে ৮০০ টাকা বিক্রি করেছেন, এমন উদাহরণ আছে। তার দৃষ্টিতে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগই এবার কাঁচা চামড়া কিনে ভালো ব্যবসা করেছেন। তবে যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ী লবণ না লাগিয়ে অতিরিক্ত দামের আশায় এক আড়ত থেকে আরেক আড়ত ঘুরেছেন, সকালের চামড়া বিকালে বিক্রি করতে গেছেন, কেবল তারাই লোকসানে পড়েছেন। চট্টগ্রামের এক মৌসুমি ব্যবসায়ী প্রতিটি চামড়া গড়ে ৫০০ টাকায় কিনেছেন।
কিন্তু আড়তদারেরা সেই চামড়ার দাম দিতে চান প্রতি পিস ৪০০ টাকার কম। অর্থাৎ লোকসান প্রতি চামড়ায় ১০০ টাকা । এর সঙ্গে গাড়ি ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই। একইভাবে রংপুরের মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, তিনি মাঝারি গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়া গড়ে ৬০০ টাকা দরে কিনেছেন।
কিন্তু আড়তদাররা তাকে ৫০০ টাকার বেশি দাম দেয়নি। যশোরেও স্থানীয় আড়তদাররা কাঁচা চামড়ার দাম বলছেন— মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কেনা দামের চেয়ে কম। তারা একেকটি গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৯০০ টাকায় কিনেছেন। লবণ দিয়ে আরও একশ’ থেকে ১৫০ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু আড়তদাররা হাটে প্রতি পিস চামড়ার দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে কম বলছে। চামড়ার দাম না থাকায় খুলনা বিভাগের সবচেয়ে বড় বাজার যশোরের রাজারহাট চামড়ার বাজারে ঈদ পরবর্তী প্রথম হাট মঙ্গলবার (১৮ জুন) একেবারেই জমেনি।
যশোরের মৌসুমি ব্যবসায়ীদেরও দাবি, সরকার নির্ধারিত মূল্যে তারা চামড়া বিক্রি করতে পারছেন না। প্রসঙ্গত, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার বাজার বসে যশোরের রাজারহাটে। ঈদ পরবর্তী সময়ে তাই এ বাজারের দিকে নজর থাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীদের।
এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা, গত বছর যা ছিল ৫০-৫৫ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় বর্গফুটপ্রতি চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে পাঁচ টাকা। অপরদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, গত বছর যা ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ক্ষেত্রে দাম বাড়ানো হয়েছে সর্বোচ্চ ৭ টাকা।
এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ২০-২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বকরির চামড়ার দাম বর্গফুট প্রতি বেড়েছে ৬ টাকা। তবে বাস্তবে খাসি ও বকরির চামড়ার দাম এবার বাড়েনি। এছাড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী, ঢাকায় মাঝারি আকারের ২৫ বর্গফুটের লবণযুক্ত চামড়ার দাম হওয়ার কথা ১৩৭৫ থেকে ১৫০০ টাকা।
এই হিসাব থেকে লবণ, মজুরি ও অন্যান্য খরচ বাবদ ২৫০ টাকা বাদ দিলে ওই চামড়ার আনুমানিক মূল্য দাঁড়ায় ১১২৫ থেকে ১২৫০ টাকা।সর্বশেষ ২০১৩ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম বেশি ছিল। সেবার গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ছিল ৮৫-৯০ টাকা। এরপর থেকে বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে।
২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর কমেছে। ২০১৯ সালে কোরবানির পশুর চামড়ার দামে বড় ধরনের ধস নামে। ন্যূনতম দাম না পেয়ে দেশের অনেক অঞ্চলে সড়কে চামড়া ফেলে দেওয়া হয় অথবা মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়।