রংপুর

উলিপুরে তিস্তার ভাঙ্গনে অর্ধশতাধিক বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন

  প্রতিনিধি ১২ অক্টোবর ২০২৪ , ৩:৩৪:৪২ প্রিন্ট সংস্করণ

উলিপুরে তিস্তার ভাঙ্গনে অর্ধশতাধিক বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন

কুড়িগ্রামের উলিপুরে থেতরাই ইউনিয়নের কুমারপাড়া ও বামনপাড়া সহ চারটি গ্রামের শতশত মানুষ তিস্তার তীব্র ভাঙ্গনের মুখে পড়েছেন। বসতভিটে নদী গর্ভে হারিয়ে মাথা গোজারা ঠাঁই খুঁজে পাচ্ছেন না এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা। বেশ কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানী ঢলে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধির ফলে চরের নিম্নাঞ্চল গুলোতে বন্যায় রুপ নিয়েছিলো। এখন নদীর পানি কমে যাওয়ায় ভাঙ্গন বৃদ্ধি পেয়েছে।

দিশেহারা হয়ে পড়েছেন উপজেলার তিস্তা নদী বেষ্টিত ৪টি ইউনিয়নের কিছু কিছু এলাকার তিস্তা পাড়ের মানুষ। এসব এলাকায় তিস্তার তিব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নিরুপায় হয়ে অন্যের জায়গায় অনাহারে অর্ধহারে দিনাতিপাত করছেন। এই সময় তিস্তার এত তীব্র ভাঙ্গন জীবনেও কখনো দেখেননি তিস্তা পাড়ের মানুষ। কুমারপাড়া ও বামনপাড়া এলাকায় গত কয়েক মাসের ব্যাবধানে প্রায় ৬০ টি বাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। 

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নদীর পশ্চিম দিকে অপরিকল্পিত ভাবে বেক্সিমকো গ্রুপের স্যোলার পাওয়ার প্লান নামে একটি স্থাপনা নির্মান করায় প্রতি বছর এসব এলাকায় নদী ভাঙ্গন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক বসতভিটা বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিঃস্ব হচ্ছে শত শত পরিবার। 

এদিকে থেতরাই ইউনিয়নে তিস্তার ভাঙ্গনে হুমকির মুখে বামনপাড়া, কুমারপাড়া, মুন্সিপাড়া ও নগরপাড়া গ্রামের প্রায় ১ হাজার পরিবারের ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার মানুষ। হুমকির মুখে আছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ১টি, মসজিদ ৪টি ও নুরানি মাদ্রাসা ১টি। এসব এলাকায় হুমকির মুখে থাকা মানুষেরা জানান, আমরা ত্রাণ চাইনা আমরা চাই নদী সংস্কার। প্রতিদিনে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে তাদের দুঃখ দূর্দশা দেখার যেন কেউ নেই। এর মধ্যে বামনপাড়া জামে মসজিদ দু’এক দিনের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। ওই এলাকার তিস্তাপাড়ের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছেন।

এছাড়াও উপজেলার বজরা, গুনাইগাছ ও দলদলিয়া ইউনিয়ন তিস্তা নদী দ্বারা বেষ্টিত। এসব ইউনিয়নের তিস্তা নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা গুলোর মধ্যে পশ্চিম বজরা, বাঁধের মাথা, উত্তর সাদুয়া দামার হাট, খামার দামার হাট নদীর পশ্চিম পাড়, সাতালস্কর, চর বজরা, সন্তোষ অভিরাম, কাজিরচক, টিটমা, ঠুটাপাইকার, কর্পুরা, লাল মসজিদ ও অর্জুন এলাকা সহ বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক দিনের নতুন করে নদী ভাঙনে একর ময় একর আবাদি জমি এবং বসতবাড়ি বড় বড় গাছ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, তিস্তা পাড়ের মানুষেরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন দিনের পর দিন। গত কয়েক মাসের ব্যাবধানে কুমারপাড়া ও বামনপাড়া এলাকায় তিস্তার ভাঙ্গনে সহশ্রাধিক একর আবাদি জমি ও পরিবার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যার পর তিস্তা পাড়ের মানুষের নতুন দুর্ভোগের স্বীকার নদী ভাঙ্গন। তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি, আবাদি জমিসহ নানা স্থাপনা। প্রতিদিন কোনো না কোনো এলাকায় বসত ভিটে ঘর বাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারা উপায়ন্তর না পেয়ে অন্যের জমিতে ঘর উঠিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, শতশত বাড়িঘর ও একরময় একর আবাদি জমি। ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষজন বসতবাড়ি রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরোধের ব্যবস্থারও দাবি জানান। ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মানুষেরা জানান, যে ভাবে নদী ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তারাতারি ভাঙ্গন প্রতিরোধের ব্যাবস্থা না নিলে এসব এলাকার ২০ থেকে ২৫টি গ্রামের ৩ থেকে ৪ হাজার পরিবারের ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ অসহায় হয়ে যাবে।

এছাড়াও গোড়াই পিয়ার দাখিল মাদরাসা, গোড়াই পিয়ার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হোকডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হোকডাঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়, দক্ষিণ চর হোকডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি ওয়ার্ড ক্লিনিক, ৪টি মসজিদ, ২টি মন্দিরসহ উক্ত গ্রাম গুলোর কয়েক হাজার পরিবার। তিস্তার ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকেরা বলেন, আমরা কোন সাহায্য চাইনা নদী সংস্কার চাই।

উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের বামনপাড়া এলাকার  বসতভিটে বিলীন হয়ে যাওয়া আলেপ উদ্দিন (৮২) বলেন, আশ্বিন ও কার্তিক মাসে তিস্তানদী এভাবে ভাঙ্গে আমার জীবনেও দেখিনি। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার বসতভিটে ভেঙ্গে গেছে সাত দিন হলো। আমি কোথাও যায়গা না পেয়ে মানুষের বাঁশঝাড়ে রেখে দিয়েছি। আম অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছি। আজ কয়েকদিন হয়ে গেলো পেটভরে খেতে পারছিনা। আমি কোথায় যাবো কোথায় থাকবো কি খাবো বলে কেঁদে ফেলেন।

বসত ভিটে বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে অন্যের বাড়িতে থাকা ফুলজান বেওয়া (৬০), মন্তাজুল মাষ্টার (৭৫), ফয়জার রহমান (৫০),সাইদুল ইসলাম (৪২), আলতাব মিয়া (৫৬), আলমগীর হোসেন (৫৫), আইয়ুব আলী (৬২) আমিনুল ইসলাম (৬২), সুক্টিমন বেওয়া (৭৫), ছাবেদ আলী (৫৮) ও হামেদ আলী (৬০) সহ আরও অনেকে বলেন, তিস্তা নদীতে সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। শত শত একর জমি বাড়িভিটে সব নদীতে চলে গেছে। তিস্তা নদী আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। আমাদের চলার মত কিছুই থাকলো না। আমরা এখন অন্যের বাড়িতে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। নদী ভাঙ্গন রোধের জন্য জিও ব্যাগ ফেলার জোর দাবী জানান।

এছাড়াও বিভিন্ন এলাকার তিস্তার পাড়ে ভাঙ্গনের কবলে পড়া সুজন মিয়া (৩৫), হক্কানি (৬৫), নুর ইসলাম (৩৬), আবু বক্কর (৭০), ছাইফুল (৪০), এমদাদুল হক (৫৬), হবিবর (৬৫), মতিন মিয়া (৫২), আজিত মিয়া (৬৫), ও আফরুজা বেগম (৪৫) সহ আরও অনেকে জানান, তিস্তার ভাঙ্গনে আমরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি। অনাহারে অর্ধাহারে দিনাপাত করছি। আমরা সাহায্য চাইনা আমরা চাই নদী সংস্কার। নদী ভাঙ্গন রোধে পর্যাপ্ত পরিমাণ জিও ব্যাগ ফেলার জোর দাবী জানাচ্ছি।

ভাঙ্গন কবলিত এলাকার স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী শিউলি খাতুন (৭ম শ্রেণি), আয়শা সিদ্দিকা (৩য় শ্রেণি), ববিতা (৪র্থ শ্রেণি) ও আকাশ মিয়া (এইসএসসি) সহ আরও অনেক শিক্ষার্থী বলেন, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে আমাদের পড়ালেখায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। আমরা স্কুলে যেতে পারছিনা। রাত্রে ঘুমাতে পারিনা। বাসায় পড়াশোনা করেতে পারিনা। তিস্তা নদী আমাদের স্বপ্ন গুলো ভেঙ্গে দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রকি হাসান বলেন, তিস্তা নদীর ভাঙ্গন এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে। ভাঙ্গন এলাকা গুলোর জন্য বরাদ্দের চাহিদা দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু কিছু এলাকায় বরাদ্দ হয়ে আসছে। এর মধ্যে থেতরাই ইউনিয়নের কুমারপাড়া ও বামনপাড়া এলাকায়  ৮হাজার জিও ব্যাগের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নদী ভাঙ্গন রোধে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া পর্যাক্রমে বিভিন্ন ইউনিয়নের ভাঙ্গন কবলিত এলাকা গুলোতে ভাঙ্গন রোধের কাজ করা হবে বলে জানান তিনি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আতাউর রহমান জানান, নতুন করে নদী ভাঙ্গনের শিকার পরিবারের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে চাল ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content