রংপুর

উলিপুরে সংকটে গরু দিয়ে হালচাষ 

  প্রতিনিধি ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৩:০৭:৪৯ প্রিন্ট সংস্করণ

উলিপুরে সংকটে গরু দিয়ে হালচাষ 

কুড়িগ্রামের উলিপুরে কালের প্রবাহে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য গরু দিয়ে হালচাষ। দিন দিন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির চিরচেনা গরু-লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের চিত্র। এক সময় গ্রামীণ কৃষকের ফসল ফলানোর একমাত্র অবলম্বন ছিল গরু দিয়ে হালচাষ। বাঙালির হাজার বছরের লালন করা ঐতিহ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিলুপ্তির পথে। বর্তমান যন্ত্রনির্ভর যুগে কৃষকরাও ধুঁকছেন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলারে জমি চাষাবাদে। তবে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষে পরিশ্রম ও সময় কমেছে। কিন্তু ফসলের গুণগতমান ও স্বাদ কমে গেছে। তা ছাড়া জমির উর্বরতাও হ্রাস পাচ্ছে।

আগে গ্রামে কিংবা শহরে হালচাষের জন্য বাণিজ্যিকভাবে গরু-মহিষ পালন করা হতো। মাঠ-প্রান্তরে প্রাই চোখে পড়ত গরু দিয়ে হালচাষ। নিজের সামান্য জমিতে হালচাষের পাশাপাশি জীবিকার উৎস ছিল। এসব চিত্র এখন দেখা যায় না। অত্যাধুনিক যুগে গরু দিয়ে হাল চাষের দেখা মেলে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার উঁচু জমিতে সবজির ফসলি জমি চাষাবাদে। সবজি চাষ করা জমিতে অনেক কৃষক বছরে ১০ থেকে ১১ বার শাক-সবজি চাষ করেন। ১০ থেকে ১১ বার জমি চাষ করতে হয়। তাই তারা গরু দিয়ে জমি চাষ করার উপর নির্ভরশীল। 

সরেজমিন উপজেলার দক্ষিন দলদলিয়া পাতিলাপুর গ্রামের গরু-লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করা কৃষক আবুল কশেম (৫৬) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তার জীবনের সিংহভাগ সময় কেটেছে হালচাষ আর গরুর পালের সঙ্গে। গরু দিয়ে হালচাষের উপকারিতা সম্পর্কে বলেন, লাঙলের ফলায় জমি গভীর পর্যন্ত ওলট-পালট হয়ে নিচের পুষ্টিগুণ ওপরে চলে আসে। বায়ু সহজে চলাচলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় ও মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। প্রাকৃতিক চাষাবাদে কেঁচোসহ উপকারী কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয় না, জমিতে ঘাস কম হয়, গরুর গোবর জমিতে পড়ে জৈব সারে ফসল ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করে দিনে আয় হয় ৯ শত থেকে ১ হাজার টাকা। প্রতিদিন হালের গরুর পিছনে ব্যায় হয় ২ শত থেকে ৩ শত টাকা। প্রতিদিন গরুর পিছনে ব্যায় হওয়ার পরেও ৬ শত থেকে ৭ শত টাকা আয় হয়। যা দিয়ে সংসার ভালই চলে। এছাড়া প্রযুক্তি দিয়ে স্বল্প সময়ে জমি চাষ করার ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ফলনও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।

একই এলাকার এলাকাবাসী আব্দুল মালেক (৫০), সাত্তার মিয়া (৬২), আবুল হোসেন (৬৫), মতলেব (৫৬) ও আলেপ উদ্দিন (৭০) সহ আরও অনেকে বলেন, আমাদের বুঝ-জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি বাপ-দাদারা ভোরের আকাশে ভেসে আসা আযানের ধ্বনির পর পরই কাঁধে লাঙ্গল-জোয়াল, মই, গরু নিয়ে মাঠে যেত হালচাষের জন্য। সকালে কাঁচা ও পোড়ানো শুকনো মরিচ, খাঁটি সরিষার তেল, সুটকি ও আলুর ভর্তা দিয়ে এক থালা পান্তা খেয়ে জমিতে যেতো। সারাদিন জমি চাষ করে বাড়ি ফিরত। বর্তমানে এ ঐতিহবাহী খাবারের সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গরু-লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ। প্রযুক্তির ছোয়ায় সব পরিবর্তন হচ্ছে। যার কারণে জমির উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে ফলনও অনেক কম হচ্ছে বলে তারা জানান। 

জমি গরু-লাঙ্গল দিয়ে চাষ করতে নেয়া জয়নাল আবেদিন (৭৫) বলেন, আমর উঁচু জমিতে শাক-সবজি ফলাতে হয়। এ সকল জমিতে বছরে ৮ থেকে ৯ বার চাষ করে শাক চাষ করতে হয়। এ সকল জমিতে প্রযুক্তি দিয়ে চাষ করা সম্ভব না। এছাড়া জমি উর্বরতার জন্য গরু-লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ ছাড়া সম্ভব না। তাই বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য গরু দিয়ে হালচাষের উপর নির্ভর করা এক মাত্র আমাদের ভরসা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষিবিদ মো. মোশারফ হোসেন বলেন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে চলছে দেশের কৃষি নির্ভর অর্থনীতি। কম পরিশ্রমে, স্বল্প সময়ে অধিক ফসল ফলাতে মানুষ এখন যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়েছে। 

আরও খবর

Sponsered content