প্রতিনিধি ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ , ১:৪১:০৯ প্রিন্ট সংস্করণ
সংগঠন বিরোধী সব অভিযোগ প্রত্যাখান করে আপাতত দল থেকে পদত্যাগ করছেন না বলে জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় দিকে বনানীর নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানান বিএনপির এই নেতা।
দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডসহ ১১টি অভিযোগ এনে গত ১৪ ডিসেম্বর হাফিজ ও বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে কারন দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল।
সব অভিযোগের জবাব দিয়ে হাফিজ, পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত জানান। তিনি আরো বলেন, দলে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনঠাসা করতে একটি মহল সক্রিয় রয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি আলোচনা সভায় যোগ দেন হাফিজ। সেখানে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ও পাঁচ জন সদস্য নিয়ে সংসদে যাওয়ার সমালোচনা করেন ৭৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক।
ওই সভায় জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিই তুলে ধরেছিলেন জানিয়ে হাফিজ বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের কোনো নেতার বিরুদ্ধে তিনি কখনও কটূক্তি করেননি। কারো বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল না তার।
হাফিজ জানান, বিএনপিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার পরও তার বিরুদ্ধে দলের কেউ কেউ সরকারপন্থীর অভিযোগ তোলে যা দুঃখজনক।
বিএনপিকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন দাবি করে হাফিজ উদ্দিন বলেন জেল থেকে বেগম জিয়া নির্দেশনা মেনে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি।
হাফিজ উদ্দিন বলেন, দলীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেই পত্রে বর্ণিত অভিযোগ সম্পর্কে আমার নিম্নরূপ বক্তব্য পেশ করছি-
১. আমাকে কখনো বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের দায়িত্ব দেয়া হয়নি।
২. জাতীয়তাবাদী কৃষকদলের কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক পদের অফার অসুস্থতার জন্য গ্রহণ করতে পারিনি। আমার বর্তমান বয়স ৭৬ বছর দুই মাস, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা স্থায়ী কমিটিতে আমার চাইতে বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা চারের অধিক হবে না বলেই আমার ধারণা।
৩. দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদানের পূর্বেই পুলিশ আমাকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার করে, এ কারণেই বরিশাল যেতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল বর্তমান সরকার। বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের মারাত্মক অভিযোগ দায়ের করার কথা আমার জানা নেই। এ মামলা ছাড়াও এক ডজন মামলায় আমি গত দশ বছর ধরে নিয়মিত হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি।
৪. ৫. ৬. বর্ণিত দলীয় সভায় আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অতীতে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ মহান মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জড়িত স্মরণীয় দিবসসমূহে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হোক, গত দেড় বছরে এ ধরনের অনুষ্ঠানেও দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আমাকে ডাকার প্রয়োজনবোধ করেননি। বোঝাই যাচ্ছে বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কোণঠাসা করে রাখার জন্য একটি মহল সক্রিয় রয়েছে। বিগত এক বছরে আমি জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত ছয়টি সভায় অংশগ্রহণ করেছি, আয়োজক জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল দুটি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি দুটি, বিএনপি ঘরানাভুক্ত সংগঠন একটি। দেশের খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধারা এই সভাসমূহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। অসৎ উদ্দেশ্যে আমি বিএনপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছি, এটি একেবারেই অসত্য ঢালাও মন্তব্য। বিগত ১২ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাব অডিটোরিয়ামে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বিমান বাহিনী প্রধানসহ অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের এক সভায় আমি শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারে অধীনে নতুন নির্বাচন দেবার জন্য দাবি জানিয়েছি।
৭. প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আমি দলীয় স্বার্থ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো বক্তব্য দিইনি। সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, এখানে আমাদের বক্তব্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রায়শ: বিকৃত এবং খণ্ডিতভাবে প্রচার করা হয়। আমি ৩৪ বছর যাবৎ রাজনীতি করছি, কখনও কারো বিরুদ্ধে এমনকি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেও রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্য রাখিনি। অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধেও অনেকবার বক্তব্য রেখেছি, কিন্তু কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করিনি।
গত ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের আলোচনা সভায় অংশ নেন বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদ। ওই অনুষ্ঠান শেষে কিছু নেতাকর্মী পুরানা পল্টন মোড় ও জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। পরে লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে এই হঠাৎ বিক্ষোভের পেছনে হাফিজ উদ্দিন ও শওকত মাহমুদের হাত রয়েছে বলে মনে করেন দলের অনেক সিনিয়র নেতা। পরে ওইদিন ( সোমবার) সন্ধ্যায় শওকত মাহমুদ ও হাফিজ উদ্দিনকে শোকজ নোটিশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
রিজভী জানান, সংগঠনে ভিতরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং দলীয় শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজ করার অভিযোগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ ও মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে শোকজ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দলের নাম ব্যবহার করে নেতা-কর্মীদের বিভ্রান্ত করে সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে কেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে কি না সে বিষয়ে শওকত মাহমুদকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এবং হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে পাঁচ দিনের মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে লিখিত জবাব জমা দিতে বলা হয়েছে।
বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে শোকজের জবাব দিয়েছেন শওকত মাহমুদ। তিনি লিখেছেন, জাতীয়তাবাদী দলের আদর্শের বাইরে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে শৃঙ্খলাবিরোধী কোনো কাজে তিনি জ্ঞাতসারে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এরপরও তার অজান্তে কোনো কাজে জড়িত থাকলে তার জন্য তিনি দুঃখিত।
হাফিজ উদ্দিন আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রী ছিলেন।
শওকত মাহমুদকে ২০১৬ সালে বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান করা হয়। এর আগে তিনি দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা শওকত মাহমুদ বিএনপি সমর্থিত সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদেরও ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক।
এর আগে, দুই নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে বিএনপি ভুল করেছে বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি মনে করেন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলা যেত। বড় দলে এমন মতবিরোধ হতেই পারে বলে মনে করছেন বিএনপির জেষ্ঠ্য নেতারা। দলের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ দুঃখ প্রকাশ করে নোটিশের জবাব দিলেও পদত্যাগের গুঞ্জন হাফিজ উদ্দিন আহমদের।
সেদিনের সেই কর্মসূচিকে সমর্থন করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, জনগণ আন্দোলন চায়। তাই দুই নেতার উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে, কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে বোকামি করেছে বিএনপি।
দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার জন্যই এই দর্শানোর নোটিশ। তাই এমন মতবিরোধ দলে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
আগামী ২০ ডিসেম্বর দুই নেতার বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত জানাবে বিএনপি।