প্রতিনিধি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৬:৪৮:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন এবং প্রশাসক হিসেবে ইউএনও ও এসিল্যান্ড দায়িত্ব নেওয়ার পরও ৬ মাসে জন্ম নিবন্ধনসহ সনদপত্র বিতরণে প্রায় ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে দাবি ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্টদের। তবে কেউই প্রকাশ্যে এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ।
এতে সরকারি ফি’র বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠলেও, সরকারি কোষাগারে ফি বাবদ কত টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, তাঁর সঠিক তথ্য দিতে রাজি হননি পরিষদে নিযুক্ত প্রশাসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। অথচ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে লিখিতভাবে এসিল্যান্ডকে জানিয়েছেন নিবন্ধক কর্মকর্তারা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় প্রশাসকদের। অভিযোগে ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (সাবেক সচিব), ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা, উপ-উদ্যোক্তা ও গ্রাম পুলিশের সদস্যরা (চৌকিদার) জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে। এদের পেছনে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা হিসেবে ইউএনও-এসিল্যান্ডসহ একাধিক কর্মকর্তার নামও উঠে আসলেও তাঁরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ও শিকলবাহা ইউনিয়নের প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত। অন্যদিকে, জুলধা, বড়উঠান ও চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরা। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন উপজেলা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন রাসেল, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দ্বিজেন ধর, সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সৈয়দা আমাতুল্লাহ আরজু, উপজেলা প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সাহাব উদ্দিন ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সবুর আলী। পাঁচ ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছেন তুহিন, মিঠুন, জনি, হোসেন ও লিজা নামে চার যুবক ও এক তরুণী। উদ্যোক্তাদের নির্ধারিত বেতন না থাকলেও, সার্ভিস চার্জের নামে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার টাকা আয় করার অভিযোগ রয়েছে। ধারণা মতে, মাসিক হিসাবে এ আয় দাঁড়ায় জনপ্রতি ৩ লাখ টাকা এবং বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকা। যদিও এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন উদ্যোক্তাদের মাসিক বেতনে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন স্থানীয়রা।
সরকারি গেজেটে ফি’র তালিকায় দেখা যায়, জন্ম বা মৃত্যুর ৪৫ দিন পর্যন্ত বিনা ফি’তে সনদ, ৪৫দিন হতে ৫ বছর পর্যন্ত দেশে ২৫ টাকা বিদেশে ১ মার্কিন ডলার, ৫ বছরের মধ্যে কোন ব্যক্তির জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন সাকুল্যে দেশে ৫০ টাকা ও বিদেশে ১ মার্কিন ডলার, জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য আবেদন ফি দেশে ১০০ টাকা ও বিদেশে ২ মার্কিন ডলার, জন্ম তারিখ ব্যতীত নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ঠিকানা ইত্যাদি অন্যান্য তথ্য সংশোধনের জন্য আবেদন ফি দেশে ৫০ টাকা ও বিদেশে ১ মার্কিন ডলার। বাংলা ও ইংরেজী উভয় ভাষায় সনদ দেশে বিদেশে বিনা ফি’তে, সনদের নকল সংগ্রহ দেশে ৫০ টাকা বিদেশে ১ মার্কিন ডলার।
স্থানীয় সরকার (ইউপি) আইন-২০০৯-এ সেবার মূল্য নির্ধারণ না থাকায় নাগরিকরা বিভিন্ন সনদের জন্য ৫০০ থেকে ২-৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে বাধ্য হন, তবে রশিদ দেওয়া হয় না। সরকার কেবল জন্মনিবন্ধনের ফি ৫০ টাকা নির্ধারণ করলেও অন্য সব সনদ ফ্রি বা নামমাত্র মূল্যে পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে অনিয়মের কারণে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী শিশুর মৌলিক অধিকার জন্মনিবন্ধন পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উদ্যোক্তা বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল উদ্যোক্তা হয়েছিলাম। সত্যি বলতে, মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত কিছু টাকা নেই, কিন্তু এই টাকা আমরা একা ভোগ করি না। উপজেলার কর্মকর্তাসহ অনেককেই এই টাকার ভাগ দিতে হয়। যা বলা যাবে না।”
ইউনিয়ন পরিষদে অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে প্রশাসন কী পদক্ষেপ নিচ্ছে তা জানতে সহকারী কমিশনার (ভূমি) রয়া ত্রিপুরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো বিষয় আমার চোখে পড়েনি। কারও অভিযোগ থাকলে তিনি সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’ অথচ তাঁর পরিচালনাধীন এক পরিষদে সরকারি ফি’র ২ লাখ ৩৮ হাজার ৩৭৫ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি বলে লিখিতভাবে জানানো হয়। যার কপি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এছাড়া মাসিক সভায়ও উত্থাপিত হলেও ইউএনও এসিল্যান্ডের নজরে পড়েনি।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাতের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের দাবি, তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে চলেন বলেই কানাঘুষা রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. নোমান হোসেন বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলা পরিদর্শন করে বিষয়টি আমিও লক্ষ্য করেছি। পরে রশিদ ছাড়া লেনদেন বন্ধ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার বাইরে নাগরিক সেবা প্রদানে টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।