দেশজুড়ে

‘জারোতে হামার কষ্ট হওচে’

  প্রতিনিধি ১০ জানুয়ারি ২০২৪ , ৫:২৩:১৩ প্রিন্ট সংস্করণ

‘জারোতে হামার কষ্ট হওচে’

পৌষের ক্রান্তিলগ্নে উত্তর জনপদে জেঁকে বসেছে হাড়কাঁপানো শীত। মাঘ না আসতেই জানান দিচ্ছে শীতের দাপট। দুদিন ধরে রংপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে মৃদু শৈত্যপ্রবাহে অনেকটাই বিপর্যস্ত জনজীবন। সূর্যের লুকোচুরিতে শীত নিবারণে পর্যাপ্ত গরম কাপড় না থাকায় নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষেরা পড়ছেন বিপাকে। আয়-রোজগারে শীতের প্রভাব পড়ায় কষ্টে আছেন দিনমজুর, শ্রমিকসহ নিম্নআয়ের মানুষেরা।  

বুধবার (১০ জানুয়ারি) সারা দিন সূর্যের দেখা মেলেনি। ফলে ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছে পুরো জেলার মানুষ। এদিন সকালে জেলার তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিনেও জেলায় একই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলেও সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো পড়া কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল প্রকৃতি। আর রাতে পথঘাটও ঢাকা পড়ে কুয়াশার চাদরে।

রংপুরে হাড়কাঁপা শীতে ঘর থেকে বের হতে পারছে না মানুষজন। দিনে সূর্যের দেখা নেই। দিন-রাতে প্রায় সমানতালে শীতের চোট অনুভব করছে নিম্নআয়ের মানুষ। অনেকেই শীতে কাবু হওয়ায় কোনো কাজ করতে পারছেন না।

মঙ্গলবার রাত ১২টার দিকে রংপুর নগরীর শাপলা চত্বরে কথা হয় জহুরুল ইসলাম নামে এক রিকশাচালকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জারোতে হামার কষ্ট হওচে। কিন্তুক বাইরোত না ব্যারাইলে খামো কী? একদিন ইসক্যা (রিকশা) না চালাইলে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ঝামেলা হইবে। সরকার তো হামাক অ্যালাও একান কম্বল দিলে না। কার কাছে জাম্পার-কম্বল চামো, ভোট শ্যাষে তো এমপি ঢাকাত চলি গেইচে।’

শীতের তীব্রতা আরও বাড়ার শঙ্কায় শঙ্কিত জেলার শীতার্ত অসহায় ও দরিদ্র মানুষজন। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দুর্ভোগও বেড়েছে কয়েকগুণ। নদী তীরবর্তী ও ছিন্নমূল মানুষেরা রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। যেন তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শীতের প্রভাব পড়েছে।

বুধবার নগরীর টার্মিনাল রোডে গনেশপুর ক্লাব মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায় শ্রমিকদের জটলা। এদের কেউ মাটিকাটা শ্রমিক, কেউবা ইমারত শ্রমিক আর কেউ কেউ বালু ও ইটবহন করে থাকেন। শ্যামপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে দিনমজুরের কাজ করতে আসা সেকেন্দার আলী জানালেন, দুদিন ধরে কাজে যেতে পারছেন না। শীতের সময় দ্রুত বেলা শেষ হয়ে যায়। এ কারণে অনেকের সঙ্গে কাজের চুক্তি মিলছে না তার।

এদিকে তিস্তা-ঘাঘট-যমুনেশ্বরী-করতোয়াসহ অসংখ্য নদ-নদীতে বিস্তৃত এ জেলার চরের মানুষেরা কৃষিনির্ভর জীবনযাপন করে। তবে গত কয়েকদিনের কনকনে শীত আর ঠান্ডায় চরের শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের মানুষজন পড়েছে বিপাকে। শীতের দাপটে অনেকের চাষাবাদেও ব্যাঘাত ঘটছে। অভাবি মানুষজন প্রয়োজনীয় গরম কাপড়ের অভাবে শীতে কষ্ট পাচ্ছে। তারা খড়খুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

গঙ্গাচড়া উপজেলার মহিপুর এলাকার কৃষক মশিউর ও জাকারিয়া জানান, ঠান্ডায় তাদের অবস্থা ভালো নেই। কোনো কাজ করতে পারছেন না। অর্থের অভাবে শীত নিবারণে গরম কাপড়ও কিনতে পারেননি তারা। গত বছরের দুটি পাতলা কম্বল জড়িয়ে থাকা এই কৃষিশ্রমিকেরা পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে আছেন বলে জানিয়েছেন।

কৃষিজমিতে কাজের জন্য কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না, যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের দিতে হচ্ছে বেশি টাকা। এতে সার, বীজ ও সেচের সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরিতে হচ্ছে বাড়তি খরচ।

কৃষকরা বলেছেন, এমন ঘন কুয়াশা পড়লে কৃষিতে ক্ষতির শঙ্কা রয়েছে। বরাবরই শীতে বোরো বীজতলা ও রবি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কোল্ড ইনজুরি ও পচনসহ মড়ক বেড়ে যায়।

রংপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকার কামরুল হাসান বলেন, কুয়াশার সাথে হিমেল হাওয়ায় বেশি ঠান্ডা পড়ছে। হাত-পা বরফ হয়ে যাচ্ছে। মানুষজন পেটের দায়ে প্রচণ্ড শীতেও কাজে বের হচ্ছে। বিশেষ করে বিকেলের পর থেকে শীতের দাপট বাড়ছে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র বিতরণ না হওয়ায় এবার শীতে ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষের কষ্ট বেড়েছে।

রংপুর প্রেসক্লাব এলাকায় পত্রিকা বিক্রেতা মঞ্জু মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আজ কুয়াশাও যেমন পড়ছে তেমন ঠান্ডাও পড়ছে। হাত-পা বরফ হয়ে যাচ্ছে। কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। বাতাস কাবু করে ফেলছে।

শীতের প্রভাবে রংপুরসহ অন্যান্য জেলায় শীত নিবারণে কম্বল, জ্যাকেট, সুয়েটারসহ গরম কাপড়ের পোশাক বিক্রির সঙ্গে জুতার দোকানে বেড়েছে ক্রেতাদের ভিড়। প্রচণ্ড শীতে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুরা ডায়রিয়া এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র ও হাসপাতালগুলোতে।

ঘন কুয়াশার সঙ্গে হিমেল হাওয়ায় পথঘাটে থাকা ছিন্নমূল অসহায় মানুষের কষ্ট বাড়িয়েছে। যদিও এই কুয়াশা আগবাড়িয়ে মনে করে দিচ্ছে শৈত্যপ্রবাহের কথা। এ রকম তাপমাত্রা আরও কয়েকদিন থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। কুয়াশার কারণে অনুভূত হবে ঠান্ডা, কমবে তাপমাত্রা। একইসঙ্গে সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত রংপুর বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও নীলফামারীর ডিমলাতে ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এছাড়া দিনাজপুরে ১১ দশমিক ৭, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও রংপুরে ১২ দশমিক শূন্য, লালমনিরহাটে ১২ দশমিক ৭ এবং গাইবান্ধায় ১৩ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মূলত কুয়াশা কেটে গেলে শীত বাড়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে জানান ওই আবহাওয়াবিদ।

রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, জেলার শীতার্ত মানুষের জন্য ৫৮ হাজার ২৫০টি কম্বল বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। তিস্তার চরসহ বিভিন্ন এলাকায় কম্বল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

আরও খবর

Sponsered content