রংপুর

ঠাকুরগাঁওয়ে ৯০ বছর বয়সী মমতার জীবন সংগ্রাম

  প্রতিনিধি ২৩ জুলাই ২০২০ , ৩:১৪:৫৭ প্রিন্ট সংস্করণ

মো. আসাদুজ্জামান শামিম, ঠাকুরগাঁও : প্রায় ৫০ বছর ধরে শহরের কোট চত্বরে বিভিন্ন উকিল-মুহুরীর চেয়ার টেবিল টানা, পরিস্কার করা, ঝাড়– দিয়ে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন মমতা বেগম (৯০)। বর্তমানে বয়সের ভারে নুয়ে পরেছেন। তার পরও প্রতিদিন সকাল ৮ টায় চলে আসেন কোট চত্বরে। বেশ কয়েকজন উকিল, মুহুরীর সেরেস্তায় চেয়ার-টেবিল গুছিয়ে দেন, ঝাড়– দেন। পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে চা-নাস্তা এনে দেন। এছাড়াও বিভিন্ন আদালত চত্বরে ঝাড়– দিয়ে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করেন মমতা বেগম। ২/১ সময় তাৎক্ষণিক অনেকেই ১০/২০ টাকা দিলেও প্রতি সপ্তাহে একদিন তিনি টাকা তোলেন। এভাবেই শত দু:খ কষ্টের মধ্যেই জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন তিনি।
মমতা বেগমের বাড়ি শহরের নিশ্চিন্তপুর ডারাপাড়ায়। ওই গ্রামের মরহুম মুক্তিযোদ্ধা মো. রমজান আলীর স্ত্রী তিনি। তার স্বামী যুদ্ধের সময় মারা যান। যুদ্ধের আগে মমতার বিয়ে হয় নীলফামারী জেলার ডিমলায়। বিয়ের পরপরই স্বামীসহ চলে আসেন ঠাকুরগাঁওয়ের নিশ্চিন্তপুর ডারাপারায়। যুদ্ধের সময় তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ মোহাম্মদ আলীর সাথে শহীদ হন। প্রথমে তার স্বামীর লাশ নিশ্চিন্তপুরে নিয়ে গেলেও পরবর্তিতে আবার শহীদ মোহাম্মদ আলীর কবরের পাশেই দাফন করা হয়। এর পর পরই তিনি শহরের কোট চত্বরে বিভিন্ন রকম কাজ কর্ম করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার শহরের কোট চত্বরে দেখা হয় মমতা বেগমের সাথে। তার সাথে কথা হলে তিনি হাসিমুখে বলেন, আমি এই চত্বরে যুদ্ধের পরপরই স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন কাজ করছি। আমার ৩ মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। সে বিয়ে করে আলাদা থাকে। আমার মেঝো মেয়েসহ আমরা নিশিন্তপুর ডারাপাড়ায় থাকি। বর্ষার কারনে বাড়িতে পানি উঠেছে। প্রতিদিন সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে ৮ টার মধ্যে কোট চত্বরে আসি। বেশ কয়েকজন উকিল-মুহুরীর সেরেস্তা ঝাড়– দেই, পানি-চা আনে দেই, চেয়ার-টেবিল আনে দেই। বিভিন্ন আদালত চত্বরও ঝাড়– দেই। থানায় ঝাড়– দেই। বিকাল ৫-৬ টার মধ্যে বাড়িতে চলে যাই। তাৎক্ষনিক অনেকেই ১০/২০ টাকা দিলেও সপ্তাহে প্রায় ৫শ থেকে ৬শ টাকা আয় হয়। এ টাকা দিয়েই দীর্ঘদিন ধরে সংসার চালিয়ে আসছি। কোন একটা ভাল কাজ পেলে হয়তো এভাবে আর কষ্ট করতে হতো না।
তিনি আরও জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার স্বামী মারা গেলেও তিনি কোন প্রকার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান না। কারণ তার কাছে স্বামীর মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কোন কাগজপত্র নেই। তিনি ও ভাই রশিদ মিয়ার যৌথভাবে একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড রয়েছে। সেখান থেকে সামান্য কিছু টাকা পান। দিনে অনেকেই সামান্য টাকা পয়সা দিলেও সপ্তাহের বৃহিস্পতিবার যাদের সেরেস্তা ঝাড়– দেন তাদের কাছ থেকে ৩০-৫০ টাকা আদায় করেন। তবে করোনা পরিস্থিতির কারনে আদালতের কার্যক্রম হালকা থাকায় উকিল কম আসেন। তাই মমতার ইনকামও কমে যায়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, গত রোজার ঈদেও শাড়ি, কাপড়-চোপড় পাইনি, এবারও পাইনি। কারণ কয়েকজনের বাড়ি গেলে হয়তো কাপড়-চোপড় পাওয়া যায়, কিন্তু করোনার কারনে এবার কারও বাড়ি যাইনি, তাই পাইনি।
মমতা বেগম এত দু:খ কস্টের মধ্যেও সব সময় হাসিমুখে চলাফেরা করেন। সকলের সাথে মেশেন। তিনি হাসিমুখে বলেন, যে কয়েকদিন আছি হাসে খেলে মরবো। কোট চত্বরে সকলে আমার চেনা। যে কোন প্রকার মামলা-মোকদ্দমা হলে বিচারক আমার পক্ষে রায় দিবেন। তারা সবাই আমাকে চিনেন। বিধবা ভাতার কার্ড পেলে আমার খুব ভাল হতো। এছাড়াও নির্দিষ্ট কোন কাজ পেলে আমাকে এভাবে আর কষ্ট করে চলতে হতো না। আমি সমাজের বিত্তবানদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি আমাকে কোন একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিলে আমার বাকী জীবন একটু ভাল ভাবে কাটাতে পারতাম।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by