প্রতিনিধি ২৭ নভেম্বর ২০২৪ , ৫:৩১:৪৪ প্রিন্ট সংস্করণ
দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবজিভান্ডার হিসেবে খ্যাতি অর্জণ করেছে পাহাড়, সমতল ও নদী পরিবেষ্টিত চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভা। চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার বুক চিরে বয়ে যাওয়া শঙ্খনদ তীরবর্তী চরের মাটি যে কোনো শাক-সবজি চাষের জন্য আদর্শ হওয়ায় বছরের ১২ মাস এখানে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদন করেন চাষীরা। শঙ্খনদের তীরে যেসব শাক-সবজি উৎপাদিত হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- মুলা, বেগুন, বরবটি, শিম, ফুলকপি, বাঁধাকপি, তিত করলা, টমেটো, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, শসা, ঢেঁড়স, ধনিয়াপাতা, লালশাক, সরিষাশাক, পালংশাক ইত্যাদি। স্বাদে অতুলনীয় এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় শঙ্খচরের শাক-সবজির চাহিদা অন্যান্য এলাকা থেকে একটু বেশি। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরীসহ আশপাশের এলাকার সবজির ঘাটতি মেটাতে বড় অবদান রাখে এখানে উৎপাদিত সবজি।
শঙ্খনদ তীরবর্তী বিস্তীর্ণ চরে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত আগাম শীতকালীন সবজি বর্তমানে বাজারে আসতে শুরু করেছে। মুলা, বরবটি, বেগুন, তিত করলা, লাউ ও মিষ্টি কুমড়া পুরোদমে বাজারে আসছে। তবে অল্প বিস্তর শিম আসলেও পুরোদমে বাজারে আসতে আরো ১০/১২ দিন সময় লাগবে বলে জানালেন চাষীরা।
গত ২৭ নভেম্বর ভোরে শঙ্খচরে গিয়ে দেখা যায় শীতের কুয়াশার মধ্যেই চাষীরা খেত থেকে সবজি তুলে এনে শঙ্খনদের পানিতে পরিস্কার করে খাঁচায় ভরে সারিবদ্ধভাবে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর কুয়াশাভেদ করে মাঝিরা নৌকা নিয়ে এসে এসব সবজি নৌকায় তুলে রওনা দিচ্ছেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ পাইকারি সবজি বাজার দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন মাঠে।
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা গ্রুপ দোহাজারী রেলওয়ে মাঠে নির্মাণ সামগ্রী রাখায় গত পাঁচ বছর এই মাঠে শাক-সবজি বিক্রি করতে পারেনি চাষীরা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে পুনরায় মাঠটি উম্মুক্ত হলে এখানে প্রতিদিন সবজি বাজার বসে। এ বাজারে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে উৎপাদিত সকল প্রকার সবজি নদীপথে নৌকা ও ইঞ্জিন চালিত বোট এবং সড়ক পথে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা, ভ্যান ও সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে নিয়ে আসেন চাষীরা।
২৭ নভেম্বর সকালে দোহাজারী রেলওয়ে সেতুর পাশে শঙ্খনদের ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সারি সারি সবজি ভর্তি নৌকা আসছে। এসব নৌকার কোনটাতে মুলা, কোনটাতে বেগুন, কোনটাতে তিত করলা ও বরবটিতে ভরপুর। প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে থেকেই চাষীরা সবজি নিয়ে আসেন এ বাজারে। ভোর থেকে সবজির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রেলওয়ে মাঠ ভরে উঠে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজিতে। সকাল ১০টা পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতার পদচারণায় মুখরিত থাকে এই পাইকারি বাজার। ব্যবসায়ীরা দরদাম করে চাষিদের কাছ থেকে সবজি কিনে ট্রাকযোগে নিয়ে যান চট্টগ্রাম নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে। তাছাড়া স্থানীয় বিভিন্ন বাজারে টাটকা সবজি কিনতে প্রতিদিন ভোরে ভিড় করেন স্থানীয়রাও। স্থানীয় কাঁচা বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও সিএনজি অটোরিকশাযোগে সবজি কিনে নিয়ে যান গন্তব্যে। প্রতিদিন এ বাজারে কয়েক ঘন্টায় আনুমানিক অর্ধকোটি টাকার শাক-সবজি বিক্রি হয় বলে জানা গেছে।
২৭ নভেম্বর বাজারে গিয়ে দেখা যায় পাইকারি হারে ১খাঁচা (৮০ কেজি) মূলা ২ হাজার থেকে ২২শ টাকা, বেগুন প্রতি কেজি ৪৫ টাকা, বরবটি প্রতি কেজি ৫০ টাকা, শিম প্রতি কেজি ৮০ টাকা, ঢেঁড়স প্রতি কেজি ৪০ টাকা, তিত করলা প্রতি কেজি ৬০ টাকা, ঝিঙে প্রতি কেজি ৫০ টাকা, চিচিঙ্গা প্রতি কেজি ৩০ টাকা, লাউ ও মিষ্টি কুমড়া আকারভেদে ৩০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বেশ কয়েকজন চাষীর সাথে আলাপকালে তাঁরা জানান, চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলায় শঙ্খনদ তীরবর্তী বিভিন্ন ইউনিয়নের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে কৃষি। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সবজির যোগান দিলেও এ অঞ্চলের চাষীরা তেমন সুযোগ সুবিধা পায় না। মৌসুমের শুরুতে সবজির দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও শেষের দিকে এসে সবজির একদমই দাম পান না চাষীরা। এরমধ্যে আবার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বেঁধে দেয়া দামেও সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হন অনেক চাষী। তাদের বেঁধে দেয়া দামে সবজি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালে সেদিন সবজি নিয়ে চরম দূর্ভোগে পড়তে হয় চাষীদের। কারণ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় চাষীদের এসব সবজি এক প্রকার বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হয় অথবা ফেলে দিয়ে চলে যেতে হয়। চাষীদের এসব সমস্যা সমাধানে এ অঞ্চলে একটি সবজি হিমাগার স্থাপন খুবই জরুরি বলে জানান তাঁরা।
দোহাজারী পৌরসভার ৭নম্বর ওয়ার্ডের কিল্লাপাড়া এলাকার সবজি চাষি আবু তাহের জানান, তিনি এবছর ৩ কানি জমিতে মূলা চাষ করে প্রায় ৩ লাখ টাকা বিক্রি করে একই জমিতে পুনরায় মুলার বীজ বপন করেছেন। দেড়কানি জমিতে করেছেন বেগুন চাষ। ইতিমধ্যে ৩ দফায় ২২ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করেছেন তিনি। ১ কানি জমিতে বরবটি চাষ করে ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার টাকার মতো বিক্রি করেছেন। এছাড়া ১ কানি জমিতে শিমের চাষ করেছেন। শিম বিক্রি করতে আরো ১৫ দিন সময় লাগবে বলেও জানান তিনি। ১কানি জমিতে মিষ্টি কুমড়ার চারা রোপন করেছেন তিনি। আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী ২ মাসের মধ্যে মিষ্টি কুমড়া বিক্রির আশা করছেন তিনি। গত বছরের তুলনায় এবছর সার, বীজ ও কীটনাশকের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। তাছাড়া কৃষি শ্রমিকদের মজুরিও বেড়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কম লাভবান হচ্ছেন তিনি। আর মাসখানেকের মধ্যে শীতকালীন সবজি পুরোদমে বাজারে এলে দরপতন হবে। এতে আর্থিকভাবে লোকসানের আশঙ্কা করছেন তিনি।
শঙ্খ চরের সবজি চাষী দোহাজারী পৌরসভার ৩নম্বর ওয়ার্ডের খানবাড়ি এলাকার শামসুল আলম বলেন, তিনি এবার ৫ কানি জমিতে মূলা চাষ করে ইতিমধ্যে সেগুলো বিক্রি করে একই জমিতে পুনরায় আবার মুলার বীজ বপণ করেছেন। এছাড়া ৩ কানি জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। ৫ দফায় ৩০ হাজার টাকার মতো বেগুন বিক্রি করেছেন। শিম চাষ করেছেন ৪ কানি জমিতে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে শিম বিক্রি করতে পারবেন। দেড় কানির মতো জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন। আর ২৫ দিন পার হলেই বিক্রি করতে পারবেন শীতের অন্যতম সবজি ফুলকপি। গত ১৫ দিন আগে আড়াই কানি জমিতে টমেটো এবং ৩ কানি জমিতে লাউয়ের চারা রোপণ করেছেন তিনি। টমেটো ও লাউ বিক্রি করতে আরো দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
দোহাজারীতে সবজির খুচরা বাজারে ২৭ নভেম্বর সকালে গিয়ে দেখা যায়, বেগুন কেজি প্রতি ৬০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা, তিত করলা ৮০ টাকা, শিম ১২০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, ঝিঙে ৬০ টাকা এবং ফুলকপি ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত মৌসুমে এ সময়ে মূলা ও বেগুন কেজি প্রতি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, শিম, ফুলকপি ও বাঁধাকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। ১০/১২ দিন পর পুরোদমে সবজি বাজার আসলে মূল্য আরো কমে যাবে বলেও জানালেন মো. মুছা নামে এক খুচরা সবজি ব্যবসায়ী।
চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. আজাদ হোসেন জানান, “চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত পুরো চন্দনাইশ উপজেলায় ১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। তন্মধ্যে শুধু দোহাজারী পৌরসভায় ৮৬০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষাবাদ হয়েছে। চলতি মৌসুমে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে সবজি আবাদের লক্ষমাত্রা রয়েছে। সবজি আবাদ বৃদ্ধি করার জন্য ইতিমধ্যে উপজেলার ৪ হাজার ৬০০ কৃষককে সবজি বীজ, সার ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ২টি পৌরসভা ও ৮টি ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাগণ কৃষকদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতা করছেন। সবজির মৌসুম কেবলমাত্র শুরু হয়েছে। আশা করি দ্রুততম সময়ে আমরা লক্ষমাত্রা অর্জণ করতে পারবো।”