প্রতিনিধি ২৭ জুলাই ২০২৪ , ৫:৪৫:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ
সকালে মোবাইলে খবর পড়ার সময় মুনাদিল আবু ইউনিসকে চমকে দেয় ইসরায়েলি বাহিনীর খান ইউনিস ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ। কয়েক হাজার লোককে এলাকা ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিল নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ঘোষিত এলাকাও। এখন পর্যন্ত মুনাদিলের জীবনে এটি ছিল অষ্টম বাস্তুচ্যুতি। তবে এবারের অভিজ্ঞতা ছিল একেবারে ভিন্ন।
এবারের খান ইউনিস ছেড়ে যাওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে মুনাদিল বলেন, ‘ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের এলাকা ত্যাগের আদেশ দিয়েছিল যখন তারা এলাকায় প্রবেশ করেছিল। আমরা তাড়াহুড়ো করে আমাদের সামান্য জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে পারলাম, বেশিরভাগ লোক কিছু না নিয়েই চলে যায়। অতীতে এমন নির্দেশের ক্ষেত্রে তারা আমাদের এক বা দুই দিন সময় দিত। কিন্তু এবার আমাদের আধা ঘণ্টাও সময় দেয়নি।’
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) পশ্চিম খান ইউনিসের বড় অংশ এবং আল মাওয়াসির কিছু অংশে বাধ্যতামূলক ফিলিস্তিনিদের চলে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেছে। যা আগে একটি ‘মানবিক অঞ্চল’ হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
গাজার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খান ইউনিস ইতোমধ্যে ভাঙাচোরা ভবনের ইট-কংক্রিট ও ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। সারা খান ইউনিসে লাখো মানুষকে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল। কেউ জানতেন না কোথায় যাবেন। ইসরায়েলি নির্দেশ প্রায় ৪ লাখ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
আইডিএফ জানিয়েছে, তারা পূর্ব খান ইউনিসে অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এই এলাকা থেকে ইসরায়েলে হামাস রকেট নিক্ষেপ করেছে বলে অভিযোগ তাদের।
কিছু লোক তাদের ফোনে ভয়েস মেসেজের মাধ্যমে এলাকা ছাড়ার খবর পেয়েছিল। খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলীয় কুজা পাড়ার ৪৩ বছর বয়সী মুহান্না কুদেহ স্থানীয় বাজারে সবজি কিনতে যাওয়ার সময় লোকজন চিৎকার করে এই বিষয়ে কথা বলছিল।
মুহান্না কুদেহ বলেন, ‘আমি আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম, এবং তারা বললো মোবাইলে রেকর্ড করা মেসেজে সবাইকে এলাকা খালি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’
তিনি জরুরি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে তার বোনের বাড়িতে গিয়ে পরিবারকে জানান। তার স্ত্রী ও তাদের তিন সন্তান তার বোনের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তাদের ঘর ধ্বংস হওয়ার পর থেকে। এটি তাদের পঞ্চম বাস্তুচ্যুতি।
খান ইউনিসের পূর্বাংশে বানি সুহাইলা এলাকায় মুনাদিল ও তার স্ত্রী এবং ছয় সন্তান তাড়াহুড়ো করে তাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করে গাড়িতে তুলতে লাগলেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বোমা হামলা কম ছিল। কিন্তু এলাকা ছাড়ার নির্দেশের এক ঘণ্টা পরেই তা তীব্র হয়ে উঠলো। তারপর, চারপাশ থেকে গোলা পড়তে লাগলো। আমি দ্রুত সরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ রাস্তায় মানুষে ভরে গেলো।’
পরিবারটি সালাহ আল-দীন রোডের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সেখানে ইসরায়েলি ট্যাংককে তারা এগিয়ে আসতে দেখলো।
মুহান্না বলেন, ‘মানুষ পালিয়ে যাচ্ছিল, যেন কেয়ামতের দিন এসে গেছে। বুলেটগুলো বৃষ্টির মতো পড়ছিল, অনেকেই আঘাত পেয়েছিল। আমরা দোয়া করছিলাম এই বিপর্যয় থেকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে।’
মুহান্না ও তার পরিবার খান ইউনিসের মধ্যাঞ্চলের কাছে তাদের বাড়ি থেকে পালানোর সময় তারা বোমাবর্ষণসহ ট্যাংক এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের মুখোমুখি হয়েছিল। কয়েকটি ড্রোন তাদের মাথার উপরে ঘুরছিল।
মানুষ সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল নিরাপত্তার সন্ধানে। মুহান্না ও তার পরিবারের মতো অনেকেই নাসের হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে শত শত আহত মানুষও উপস্থিত হয়েছিলেন। ইতোমধ্যে হাসপাতালের অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়েছে।
গাজা স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা নাগাদ, পুনরায় বোমা হামলায় ৭০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং অন্তত ২০০ জন আহত হয়েছেন। চিকিৎসকরা রক্তদান এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের জন্য আবেদন জানিয়েছেন। যাতে করে তারা আহতদের চিকিৎসা করতে পারেন। অনেক আহতকে হাসপাতালে জায়গার অভাবে মেঝেতে বা বিছানার মধ্যে রাখা হয়েছিল।
হাসপাতালের বাইরে যারা জমায়েত হয়েছিল তারা পায়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছেছিলেন। পালানোর তাড়াহুড়োতে তাদের জিনিসপত্র ফেলে রেখে এসেছেন। আমাল নামের এক নারী বলেন, ‘বোমা হামলা থেকে পালানোর সময় আমি নিহত ও আহত লোকজনকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেছি। কেউ তাদের বাঁচাতে বা এমনকি লাশ সংগ্রহ করতে পারছিল না, কারণ বোমা হামলা এতটাই ভয়াবহ ছিল … বিভিন্ন ধরনের বিমান সব সময় খুব কম উচ্চতায় উড়ছিলো।’
ইসরায়েলি ট্যাংকগুলো খান ইউনিসের প্রান্তে বানি সুহাইলায় গভীর প্রবেশ করেছিল। একই সময় ইসরায়েলি সেনারা বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়।
যারা বোমা ও গোলাবর্ষণ থেকে বাঁচতে পালিয়েছিলেন, তাদের সর্বশেষ বাস্তুচ্যুতি নতুন সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। পালানোর কোনও নিরাপদ জায়গা না থাকায়, আমালের মতো অনেকেই সপ্তাহটি খোলা আকাশের নিচে কাটিয়েছিলেন।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ আরও ৩০ জন নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ১৫০ জন আহত হয়েছেন।
আমাল আরও বলেন, আমরা কোথাও থিতু হতে পারিনি কারণ অনেক বাস্তুচ্যুত মানুষ ছিল। প্রথমে আমরা একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপরে বসেছিলাম। অনেক বাস্তুচ্যুতদের সঙ্গে আমরা এখন খোলা আকাশের নিচে আছি। আমরা এমন জায়গায় আছি যেখানে পানি নেই, পানি কিনতে অনেক দূর হেঁটে যেতে হয়। খাবার খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।
তিনি বলেন, আমরা বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছি, কিন্তু এবার ছিল ভিন্ন এবং আমরা আমাদের সব কিছু হারিয়েছি। এই যুদ্ধের মধ্যে এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে কঠিন দিন।
মুনাদিল বলেছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত খান ইউনিসের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আশ্রয় পেয়েছিলেন, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে এখান থেকেও সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তার কথায়, ‘আমরা মরতে চাই, কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। আমরা ক্লান্ত, চলতে পারছি না। এই ১০ মাসে আমরা আমাদের বয়স দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান