প্রতিনিধি ৩ মার্চ ২০২৫ , ৩:১৩:১৪ প্রিন্ট সংস্করণ
কুড়িগ্রামের উলিপুরে তিস্তার চরগুলোতে নিত্যপণ্য ও কৃষিপণ্য পরিবহনে অন্য কোন মাধ্যম না থাকায় ঘোড়ার গাড়ি হচ্ছে তাদের একমাত্র ভরসা। রাস্তাঘাট না থাকায় অধিকাংশ ঘোড়ার গাড়িচালকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটে বেড়াচ্ছে এক চর থেকে অন্য চরে। ফলে চরের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখছেন ঘোড়ার গাড়ি। কৃষিপণ্য আনা-নেওয়া ও যাতায়াতের জন্য ব্রীজ নির্মাণের দাবী জানান চরের মানুষেরা। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বছরের বাকি সময় তিস্তা নদীতে পানি থাকে না বললেই চলে। নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের সহজ মাধ্যম নৌকা হলেও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য মাধ্যম হলো ঘোড়ার গাড়ি।
জানা গেছে, উপজেলার বজরা, গুনাইগাছ, থেতরাই ও দলদলিয়া ইউনিয়ন তিস্তা নদী দ্বারা বেষ্টিত। শুকনো মৌসুমে গোড়াই পিয়ার, রামনিয়াশা, হোকডাঙ্গা, টিটমা, নাগড়াকুড়া, দড়িকিশোরপুর, মধ্য গোড়াই, কদমতলা, অজুর্ন, বিরহিম, সন্তোষ অভিরাম, সাদুয়া দামারহাট, কর্পূরা, খারিজা লাটশালাসহ অসংখ্য চরে কখনো হাটুপানি ভেঙে ও বালুচরে মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে ঘোড়ার গাড়ি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে নদ-নদী। শুকনো মৌসুমে চোখে পড়ে শুধুই বালুচর। জীবিকা রক্ষায় চরের মানুষ এই ঘোড়াগাড়ির উদ্ভাবন করেছেন। ফলে মানুষের দুর্ভোগ অনেক কমেছে। চরাঞ্চলে যান্ত্রিক যানবাহন না থাকায় আগের দিনের মানুষ প্রচণ্ড গরমে উত্তপ্ত বালুতে পায়ে হেটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিত এবং নিজেদের উৎপাদিত পণ্যগুলো মাথায় অথবা লাঠিতে করে ঘাড়ে নিয়ে বহন করতো। কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি চালু হওয়ায় পর চরাঞ্চলের মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহনসহ ব্যবসায়ীদের পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য একমাত্র মাধ্যম হিসেবে গাড়িটি ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। বর্ষার সময়ে তিস্তা নদী তার চিরচেনা রুপ-যৌবন ফিরে পায়, পানিতে তলিয়ে যায় প্রত্যন্ত চরের নিম্নাঞ্চল। এসময় চরবাসীর একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম হয়ে থাকে নৌকা। তবে শুকনো মৌসুমে যাতায়াতের একমাত্র প্রধান মাধ্যম ঘোড়ার গাড়ি। আর প্রত্যন্ত এসব চর এলাকার অনেক মানুষ ঘোড়ার গাড়ি দিয়েই তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তার চরাঞ্চালে শুকনো মৌসুমে নদীতে পানি কমে যায় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠে। চরে যাতায়াতের জন্য যান্ত্রিক গাড়ি, ভ্যান, রিকশা, অটো, মাইক্রো চলাচল একেবারেই অসম্ভব। তাই এই এলাকার যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার হয়। চরাঞ্চলের রাস্তাঘাট না থাকায় এখানে যান্ত্রিক গাড়ি না চলায় চরবাসীকে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। এসব সমস্যাকে উপেক্ষা করে তাদের নিত্য দিনের কাজ পরিচালনার জন্য তারা ব্যবহার করেন অযান্ত্রিক ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ি কৃষকদের পণ্য পরিবহণ, অসুস্থ মানুষদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা ঘাটে পৌঁছে দেওয়া, চরাঞ্চলের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং চরবাসীর অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। তারা দাবী করেন আমাদের চলাচলের জন্য একটা ব্রীজ নির্মান করে দিলে একদিকে কৃষিপণ্য আনা-নেওয়ায় অনেক সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে অসুস্থ রুগীদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। তাই তারা ব্রীজ নির্মানের জোর দাবী জানান।
উপজেলার গোড়াইপিয়ার চরাঞ্চলের ঘোড়াগাড়ি চালক রুহুল আমীন বলেন, তিস্তার চরাঞ্চলে সবসময় বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ হয়েই থাকে। বর্তমান আলুর চাষ হয়েছে। বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে বস্তা প্রতি ৩০ টাকা দরে ঘাট পাড়ে পৌঁছে দেই। এভাবে দিনে প্রায় ৫০ বস্তা পর্যন্ত ঘাট পাড়ে নিয়ে আসা যায়। তাতে প্রতিদিন আয় হয় ১ হাজার থেকে ১৫’শ টাকা। ঘোড়ার খাদ্যে প্রতিদিন খরচ হয় ২শ ৫০ টাকা। বাকি টাকা দিয়ে আমার সংসার ভালোই চলে।
ঘোড়ার গাড়ি চালক মধু মিয়া, কুদ্দুস মিয়া, লাল মিয়া ও আসাদুল ইসলামের সহ আরও অনেকে বলেন, তিস্তার চরে শুকনো মৌসুমে ৪-৫ মাস চলে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে পবিহনের কাজ। মে মাসের মাঝামাঝি তিস্তা নদীতে পানি এলে বন্ধ হয়ে যায় ঘোড়ার গাড়ি।
তখন থেকে তারা আবার অপেক্ষায় থাকেন কবে তিস্তা নদী শুকিয়ে যাবে।
উপজেলার তিস্তার চরে আলু চাষি আনারুল ইসলাম জানান, আমার ২০ একর জমিতে চাষ করা ৩ হাজার ৪’শ বস্তা আলু এক মাত্র ঘোড়ার গাড়ি করে ঘাটে নিয়ে এসেছি। ঘোড়ার গাড়ি পরিবহণ খরচ বস্তা প্রতি ৩০ টাকা করে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, যাতায়াতের জন্য একটা ব্রীজ নির্মাণ করা হলে আমাদের পণ্য বহনে অনেক সাশ্রয় হত।
উপজেলার তিস্তা পাড়ের পানিয়ালের ঘাটের মালিক সোহরাওয়ার্দী জানান, এখন তিস্তা নদীতে পানি অনেক কম। চর ভেসে উঠেছে যেখানে বালু আর বালু। এই চরাঞ্চলে কৃষি পণ্য বহন করার জন্য এক মাত্র উপায় ঘোড়ার গাড়ি। নদীতে পানি এসে যখন নদী জীবন ফিরে পায় তখন নৌকা দিয়ে পারাপার করা হয়।
বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে কৃষি পণ্য ঘোড়ার গাড়িতে নিয়ে এপার থেকে ওপারে নিয়ে আসা যাওয়া করছেন। যখন তিস্তায় পানি কমে যায় সামান্য পানির উপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মালামাল পার করা হয় বলে জানান।