গণসঙ্গীতে তিনি যে ‘মশাল’ জ্বালিয়ে গেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তা ধরে রাখার আহ্বানে শনিবার বৃষ্টিভেজা এক দুপুরে ফুলেল শ্রদ্ধায় তাকে চির বিদায় জানানো হল।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার মারা যান ফকির আলমগীর৷ এরপর তার মরদেহ হাসপাতালের হিমাঘরে ছিল৷
শনিবার সকালে সেখান থেকে ঢাকার খিলগাঁওয়ের পল্লীমা সংসদ প্রাঙ্গণে নেওয়া হয় তার কফিন। সেখানে জানাজার পর ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয় একাত্তরের এই কণ্ঠযোদ্ধাকে।
জাতীয় পতাকায় আচ্ছাদিত কফিন এরপর নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে বাদ জোহর খিলগাঁও মাটির মসজিদে জানাজা শেষে তাকে খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে দাফনের জন্য নেওয়া হয়।
দুপুর পৌনে ১২টায় ফকির আলমগীরের মরদেহ নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বৃষ্টির কারণে আধা ঘণ্টা দেরিতে শুরু হয় নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব, যার ব্যবস্থাপনায় ছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার দুপুরে একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী প্রয়াত ফকির আলমগীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
প্রথমেই আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ চুমকি, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া৷
শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা স্ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ, পথনাটক পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, ছাত্রলীগ, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়, স্পন্দন, আদিঢাকা সাংস্কৃতিক জোট, যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, জাসদ, ছাত্রমৈত্রী, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ফুলেল শ্রদ্ধা জানায় তার প্রতি।

ফকির আলমগীর
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফকির আলমগীরের স্ত্রী সুরাইয়া আলমগীর বলেন, “সে যেই বিপ্লবী কণ্ঠে গানগুলো লিখে গেছে, গণসঙ্গীতের প্রজ্জলিত মশাল রেখে গেছে, আগামী প্রজন্ম যেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম গানগুলোকে ছড়িয়ে দেয়।
“কৃষক-শ্রমিকের গান, স্বাধীনতার গান যেন সংরক্ষিত হয়। তাহলে আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে। ফকির আলমগীর ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।”
বাংলাদেশে গণসঙ্গীতের কথা বলতে গেলে আসবে ফকির আলমগীরের গান। তার বন্ধু কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের ভাষায়, “গণসংগীত বলতে যেটা বোঝায়, সেই জায়গায় তেমন কেউ কাজ করেনি, কিন্তু ও করেছে। জায়গাট কেউ ধরে রাখতে পারেনি, আবার চেষ্টাও করেনি। ওর মৃত্যুতে গণসংগীতের জায়গাটা শূন্য হয়ে গেল।”
ফকির আলমগীরের জন্য দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকের প্রত্যাশা রেখে স্ত্রী সুরাইয়া বলেন, “তার একটি আফসোস ছিল, স্বাধীনতা পদক দেখে যেতে পারলেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন এই পদকটি দেন, তার আত্মার শান্তির জন্য।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার দুপুরে একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ছবি: মাহমুদ জামান অভি
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, “ফকির আলমগীর শুধু একজন গণসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তা নয়, তিনি বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন।
“নব্বইয়ের দশকে গণআন্দোলনের ইতিহাসে তার অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ফকির আলমগীরের চলে যাওয়া একজন কিংবদন্তির প্রস্থান।”
নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মহমুদ চৌধুরী বলেন, “তার যে গাওয়া গান ‘মায়ের একধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোষ বানাইলে ঋণের শোধ হবে না’ এই যে মাকে গানের মধ্যে দিয়ে সন্মান দিয়ে গেছেন।
“‘হেনরি, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা’কে বাংলার মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। সংস্কৃতিকে তিনি মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন। খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলেছেন। অধিকারের কথা গানে গানে তুলে ধরার মানুষকে আমরা হারালাম।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শনিবার দুপুরে একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ছবি: কাজী মোবারক হোসেন
জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “ফকির আলমগীর যুদ্ধের সময় যুদ্ধ করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানুষ যখন দুঃখ-দুর্দশায়, তখন গানের মাধ্যমে আশা জাগিয়েছেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ফকির আলমগীরকে স্মরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখরুজ্জামান বলেন, “গণমানুষের সঙ্গীত পরিবেশনে যে অনন্য অবদান রেখেছেন, এর জন্য তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদান স্মরণ করে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, “গণমানুষকে সম্পৃক্ত করে যে কোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক পরিণতিতে নেওয়ার যে ধরনের গান তিনি গেয়েছেন, তাতে মানুষের মনে স্থান তৈরি করেছেন।”