দেশজুড়ে

ধোবাউড়ায় ফেসবুক পোষ্টকে কেন্দ্র করে অসহায় বৃদ্ধা পেল স্বপ্নের ঘর

  প্রতিনিধি ২২ জুন ২০২০ , ৫:১৬:০১ প্রিন্ট সংস্করণ

ধোবাউড়ায় ফেসবুক পোষ্টকে কেন্দ্র করে অসহায় বৃদ্ধা পেল স্বপ্নের ঘর

ধোবাউড়া (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি : কবি হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, কষ্ট নেবে কষ্ট, হরেক রকম কষ্ট আছে। ধোবাউড়া উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের পশ্চিম শালকোনা গ্রামের সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব অশীতিপর বৃদ্ধা ময়মনা খাতুনের কষ্টের করুণ কাহিনী শুনে মনে হলো পৃথিবীতে আসলেই একজন মানুষের জীবনে এতরকম কষ্ট থাকতে পারে! শুনে দেখুন আপনার চোখ জলে ভিজে উঠবেই।

প্রায় ৮০ বছর বয়সী ময়মনা খাতুনের স্বামী আব্দুল জলিল মারা যান প্রায় ২০ বছর আগে। ৫ বছর আগে অসুস্থ ছেলেদের চিকিৎসার জন্য পাশের বাড়ির ভাইয়ের কাছে বিক্রি করেন বসতভিটা। কিন্তু তার ১ বছর পরেই (অর্থাৎ ৪ বছর আগে) কিছুদিনের ব্যবধানে মারা যান ২ টি ছেলেই। সর্বস্ব হারানো ময়মনা কে তবুও তার বসতভিটাতেই আমৃত্যু থাকতে বলেছিলেন জমি ক্রয়কারী ভাই।

কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ে বসতভিটার কাঁচা ঘরটিও ভেঙ্গে যায় তার। তারপর থেকে ময়মনার আশ্রয় হয় পাশের বাড়ির ভাতিজা ইছব আলীর রান্নাঘরে। ময়মনা খাতুন বয়স্ক ভাতা পান আর এর-ওর সাহায্য নিয়ে অতি কষ্টে ঐ রান্না ঘরেই কাটছিলো তার চিরদুঃখী জীবন। কখনো কল্পনাও করেননি নিজের সুন্দর একটা ছোট্ট ঘরে আবার কোনোদিন থাকতে পারবেন। কিন্তু হঠাৎই যেন তার সবকিছু পাল্টে যায় স্বপ্নের মতন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এরশাদুল হক সুমনের ময়মনা খাতুনকে নিয়ে একটি ফেসবুক পোষ্টকে কেন্দ্র করে তার জীবনে ঘটে গেছে অভাবনীয় ব্যাপার। এখন তিনি নিজের ছোট্ট-সুন্দর একটা ঘরে থাকেন।

সেই ছোট্ট স্বপ্নের ঘরের বারান্দায় বসে ময়মনা খাতুন বলেন- আল্লাহ্ বেককিছু দেখতাছুইন, যারা আমারে সাহায্য করছে তাদের লাইগ্যা পরাণ ভইরা দোয়া করি, আল্লাহ্ যেন তাদের বেক সময়ই ভালা করুইন।

ময়মনা খাতুনকে দেখতে গিয়ে কথা হয় ঢাবি শিক্ষার্থী এরশাদুল হক সুমনের সাথে, কিভাবে ঘটলো সবকিছু, গল্পটা শুনতে চাই। সুমন বলতে শুরুকরে- করোনা সংকট শুরুহলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়, চলে আসি গ্রামের বাড়িতে। এসে প্রানের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন “মানবতার মিছিল” থেকে আমরা ২০৪টি পরিবারকে ভালোবাসার থলে পৌঁছে দেই, যারা এই ক্রান্তিকালে খুব কষ্টে ছিল। সাথে সাথে নেমে পড়ি করোনা যুদ্ধে উপজেলা কুইক রেসপন্স টিমের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তারপর রাত দিন শুধু একটাই ভাবনা ছিল যে, আমার আশে পাশে যদি কোন মানুষ কষ্টে থাকে তার জন্য কিছু করতে হবে।

তারই প্রেক্ষিতে আমার বাবার সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম এই বৃদ্ধা মায়ের অসহায়ত্বের কাহিনী। বাবার মুখে শুনেও নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না তাই নিজের চোখে দেখতে যাই ২৬-০৪-২০২০ সকাল ৭ ঘটিকার দিকে। গিয়ে যা দেখলাম তার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা যা বলেছিলেন তার থেকেও অবস্থা ছিলো আরো করুণ। তারপর ঐখানে দাঁড়িয়েই আমি বৃদ্ধা মায়ের অসহায়ত্বের কাহিনী ছবিসহ আংশিক তুলে ধরে ফেসবুকে একটি পোষ্ট দেই।

সাথে সাথে আমাদের “মানবতার মিছিল” সংগঠনের অন্যতম মেন্টর সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জয় প্রকাশ সাহা দাদা ও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক ভাই কিছুদিনের জন্য আনুসাঙ্গিক খাবারের ব্যবস্থা করে দেন, এবং পরবর্তীতেও ঘরের জন্য চৌকিসহ আনুসাঙ্গিক জিনিস ক্রয় করতে সহায়তা দেন। তারপর তাদের পরামর্শে বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব রাফিকুজ্জামান স্যার কে জানাই আমার ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে।

জানার সাথে সাথে স্যার সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ২ বান্ডিল টিন ও ৬০০০/ (ছয় হাজার) টাকার ব্যাংক চেক প্রদান করেন। আর আমার সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া পোস্ট দেখে অনেকে অর্থ ও খাদ্য সহায়তা দেওয়ার আগ্রহ জানায় এবং সহায়তা প্রদান করেন। আমি এবং আমার স্বেচ্ছাসেবক টিমের সদস্যরা মিলে সেই সহায়তা দিয়ে বৃদ্ধা মায়ের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমে একটি ছোট্ট ঘর তৈরী করি এবং ২ মাসের খাবারের ব্যবস্থা করেও আরও ৩টি অসহায় পরিবারকে খাবার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হই।

যারা এই মহৎ কাজে খাদ্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন এবং বৃদ্ধা মাকে একটি ছোট্ট সুন্দর ঘর এবং সেই ঘরের আনুসাঙ্গিক সকল আসবাবপত্র কিনে দিতে সহায়তা করেছেন, সেইসব মহান হৃদয়ের মানুষ গুলোর নাম উল্লেখ করতে চাই, যাতে করে অন্যরাও উৎসাহিত হয়ে সমাজের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়ান। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব রাফিকুজ্জামান, জালাল উদ্দিন সোহাগ, জয় প্রকাশ সাহা, সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, সাইফুল্লাহ সুমন, খাঁন আলী মুর্তজা, শফিক তালুকদার, জুবায়ের হোসেন, আলী মামুন খাঁন রিপন, জহিরুল মির্ধা, এডভোকেট মামুন মির্ধা, নুরে আলম নুরু।

আল্লাহর অশেষ রহমতে, এই মানবদরদি মহৎ মানুষগুলোর সহায়তায় গত ২২ মে ২০২০ আমরা বৃদ্ধা মাকে তার স্বপ্নের ছোট্ট ঘরে পার করে দিতে সক্ষম হই। ময়মনা খাতুনের স্বপ্নের ঘর/ মানবতার ঘর/ ভালোবাসার ঘর দেখে আসতে আসতে মনে হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কত অসাধারণ মহৎ কাজই না করা যায়! অথচ আমরা আত্মপ্রচার, গুজব প্রচার, আর কাঁদা ছুড়াছুঁড়িতে বৃথাই সময় কাটাই!

আরও খবর

Sponsered content

Powered by