প্রতিনিধি ২৩ জুন ২০২৪ , ২:৩৬:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দলটি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে ব্র্যাকেটবন্দি হয়ে পড়ে। নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয় অনাস্থা ও অবিশ্বাস। নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে দলের মধ্যে সৃষ্টি হয় একাধিক বলয়। বার বার ভাঙনের মুখে পতিত হয় দেশের ঐহিত্যবাহী এ দলটি।
ঠিক তেমনই এক ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে কাউন্সিল সর্বসন্মতিক্রমে দলের প্রধান নির্বাচিত করে। পরে ওই সময়কার সরকারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধীন বাংলার মাটিতে আবারও নবজীবন লাভ করে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ ছয় বছরের অচলাবস্থা কাটিয়ে স্বৈরাচার ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে আবারও রাজপথে সক্রিয় হয়ে ওঠে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ।
এরপর থেকে আন্দোলন-সংগ্রামে লিপ্ত হন বঙ্গবন্ধুকন্যা। দেশে ফেরার পর কয়েক বছর ধরে সারা দেশের প্রতিটি প্রান্ত ঘুরে গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তব জীবনচিত্র উপলব্ধি করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। একইসঙ্গে বহুমুখী প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে পিতা মুজিবের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে সুসংগঠিত করে তোলেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।
এ সময় আওয়ামী লীগকে থামিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র সফল করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকন্যাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। আন্দোলন সংগ্রামের পথে ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক সরকার শেখ হাসিনাকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি এবং একই বছরের নভেম্বর মাসে তাকে দু’বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালে ১১ নভেম্বর তাকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ১৯৯০ সালে ২৭ নভেম্বর শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ করা হয়।
দেশবিরোধী অপশক্তি ও স্বৈরাচারের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র, হামলা এবং বুলেট-বোমার ভয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিচলিত না হয়ে জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরও জোরদার করেন। ফলশ্রুতিতে পতন ঘটে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার। তবে সুক্ষ্ম কারচুপি ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের কারণে সংখ্যায় বেশি ভোট পেয়েও আসন সংখ্যার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত টানা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় টিকে থাকার ষড়যন্ত্র করলে দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা তা রুখে দেন। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর একই বছরের ১২ জুন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে আবারও পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। ওই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুতুল তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে বিএনপি। এর জের ধরে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়।
ওয়ান-ইলেভেনের ওই সরকারের সময় মাইনাস টু ফর্মুলার নামে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে সরানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। দলের একাধিক নেতা ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে, দলের কিছু ত্যাগী নেতা ও তৃনমূলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে সেই সময়ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় আওয়ামী লীগ। এ সময় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে তার নামে ১৩টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।
২০০৮ সালের ২৩ মে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় দলের ৭২টি সাংগঠনিক শাখার তৃণমূল নেতারা শেখ হাসিনার প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন এবং তাকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য দেশজুড়ে চলমান আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন। আওয়ামী লীগের এই ঘোষণার পর দেশজুড়ে শুরু হয় গণগ্রেফতার। কিন্ত তবুও শেখ হাসিনার পক্ষে গণজোয়ার থামানো যায়নি। অবশেষে জননেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের সামনে কুচক্রীদের সব রকমের ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ২০০৮ সালের ১১ জুন তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও দুঃসাহসী নেতৃত্বে ভর করে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আয়োজিত জাতীয় নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের জোট। যে ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিল, সেই ওয়ান- ইলেভেনের সূত্র ধরে শেখ হাসিনা দলে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। শেখ হাসিনা দলের জন্য অপরিহার্যরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
৪২ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার হামলার মুখে পড়েন। তাকে হত্যার উদ্দেশে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ৩০ জন নেতাকর্মী নিহত হন। লালদিঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুই বার গুলি বর্ষণ করা হয়। ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের উপ-নির্বাচন চলাকালে তাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়।
১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে ট্রেনে তার কামরা টার্গেট করে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং তার জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুঁতে রাখা হয়। বিএনপি সরকারের সময় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। ওইদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিন্যুতে এক জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ তার দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫ শ’র বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে আঘাত পান।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ তার মতামতে বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগকে এদেশের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। দুই যুগের অধিককাল স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত। জাতির জনকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আসীন করেছেন।
তিনি বলেন, জাতির জনক দু’টি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি নিষ্ঠা, দক্ষতা ও সততার সঙ্গে করে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।