রাজশাহী

আর্সেনিক শুধু ক্যানসার নয়, ভূমিকা রাখে ডায়াবেটিস-হৃদরোগে

  প্রতিনিধি ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ , ৮:৩১:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

ভোরের দর্পণ ডেস্ক :

১৩ বছর ধরে মানবদেহে আর্সেনিকের প্রভাব নিয়ে গবেষণায় সাফল্য পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এনভায়রনমেন্ট হেলথ সায়েন্স রিসার্চ গ্রুপ। এই রিসার্চ গ্রুপ মানবদেহের আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। সম্প্রতি তারা আর্সেনিক কীভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সে বিষয়ে নতুন তথ্য উপাত্ত উপস্থাপনা করেছেন।

সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, আর্সেনিক বিষক্রিয়ার ফলে ক্যানসার হয়। কিন্তু শুধু ক্যানসার নয়, কীভাবে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও অ্যাজমা রোগে ভূমিকা রাখে তা তাদের যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স রিসার্চ গ্রুপ ও প্রফেসর হিমেনোর সঙ্গে যৌথ গবেষণায় বলা হয়, আর্সেনিক বিষক্রিয়া অনেক নন-ক্যানসারস প্রাণঘাতী রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় মানুষের মাংসপেশি কমে যায়। পরে ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

এই গবেষণাটি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। খুব কম সুযোগ সুবিধার মধ্যে কীভাবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন গবেষণা করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ গ্রুপ। তাদের গবেষণা কর্মে প্রথমদিকে আংশিক অর্থায়ন করেছে ইতালির ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি সায়েন্স। সীমিতভাবে সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই গবেষণায় ব্যয় হয়েছে  মোটা অংকের টাকার রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। আর এই রাসায়নিক দ্রব্যাদি এবং যন্ত্রপাতি দিয়ে এই গবেষণায় সাহায্য করেছেন জাপানের টুকুশিমা বুনরী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক (বর্তমান সোয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভিজিটিং প্রফেসর) ড. সেইইচিরো হিমোনো।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যখন গবেষণার ফান্ডের জন্য আবেদন করে বারবার ব্যর্থ হয়েছি, তখন প্রফেসর হিমেনো জাপানে আমাদের গবেষণার ওপর প্রকল্প জমা দিয়ে প্রায় প্রতিবারেই সফল হয়েছেন। ১৩ বছর ধরে নিরবিচ্ছন্নভাবে আমাদের গবেষণায় সাহায্য করেছেন।

গবেষণা টিমের সদস্যরা

 

ড. খালেদ আরও বলেন, ‘ড. প্রফেসর হিমেনো কখনো আমাদের গবেষণার পরিকল্পনায় হস্তক্ষেপ করেন না। বরং নিরবিচ্ছন্নভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন। রাসায়নিক দ্রব্যাদি সরবরাহ করেছেন ও মূল্যবান ইকুপমেন্ট ব্যবহার করে আমাদের পাঠানো নমুনা অ্যানালাইসিস করে দিয়েছেন। এমনকি অনেক গবেষণা পেপার প্রকাশের জন্য পাবলিকেশন চার্জ তিনি প্রদান করেছেন।’

ইতিমধ্যে ৩০টির মতো গবেষণাকর্ম আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। সাতটির মতো গবেষণাকর্ম ১০ কাছাকাছি অথবা অধিক ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর (কোনো জার্নালের মান বিবেচনার একটি উল্লেখযোগ্য মানদণ্ড হলো ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর) সম্পন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

মাংসপেশিতে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার প্রভাব নিয়ে ইঁদুরের ওপর গবেষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত গবেষক প্রফেসর অ্যারন বারচোয়েস্কি। ড. খালেদ ও প্রফেসর হিমোনোর যৌথ গবেষণার ফলাফল প্রফেসর অ্যারনের দৃষ্টি গোচর হয়। এরপর প্রফেসর অ্যারন, ড. খালেদ ও হিমেনোর সঙ্গে যৌথ গবেষণায় আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরে খালেদকে তার সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুলব্রাইট ফেলোশিপের মাধ্যমে তার ল্যাবে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে ড. খালেদ তার সঙ্গে ছয় মাস গবেষণা করেন। ইতোমধ্যে প্রফেসর হিমেনো জাপানিজ সোসাইটি ফর প্রমোশন অব সায়েন্স থেকে বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের মধ্যে ত্রিদেশীয় গবেষণার জন্য গবেষণা অনুদান লাভ করেন। এই গবেষণার মূল ফোকাল পয়েন্টে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স রিসার্চ গ্রুপ। এই ত্রিদেশীয় গবেষণার ফলে আর্সেনিক কীভাবে মাংসপেশি হ্রাসের মাধ্যমে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস তৈরি করে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই গবেষণার অন্যতম উদ্যোক্তা ড. খালেদ।

এই গবেষণার জন্য খুবই মূল্যবান দুটি যন্ত্র প্রফেসর হিমোনো জাপান থেকে নিয়ে এসেছেন, যা দিয়ে ইতিমধ্যে মাঠ পর্যায়ে পাইলট স্টাডি সম্পন্ন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের দুটি নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আর্সেনিক বিষয়ে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ তথা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণা একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

আর্সেনিক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখায় ড. খালেদকে যুক্তরাষ্ট্রের পির্টাসবাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অকুপেশনাল ও এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স বিভাগ অ্যাডজাঙ্কড ফ্যাকাল্টি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তার এই নিয়োগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নততর গবেষণার স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের জন্য গর্বের।

ড. খালেদের গবেষণা কার্যকে ত্বরান্বিত করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রদান করেছেন।

বর্তমানে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ সায়েন্স গ্রুপের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন এই বিভাগের প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ এবং ড. সাখাওয়াত হোসেন। প্রায় ১৫ জন মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং একজন পিএইচডি পর্যায়ের গবেষক নিয়ে এই রিসার্চ গ্রুপ গঠিত। এই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ৪০ জন মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থী এবং ৯ জন পিএইচডি পর্যায়ের গবেষক তাদের গবেষণা কর্ম শেষ করেছেন। এদের মধ্যে অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্নদেশে উন্নততর গবেষণায় যুক্ত আছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, আর্সেনিকের প্রভাব নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এই প্রথম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গবেষণা করে একটি যুগান্তকারী ফল উপস্থাপন করেন। এই গবেষণা কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, বিশ্বে বাংলাদেশের অর্জনকে আরও গৌরবান্বিত করবে।

Powered by