আন্তর্জাতিক

কী ঘটেছিল দিল্লির স্টেশনে, কেন প্রাণ গেল ১৮ জনের

  প্রতিনিধি ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ , ৭:৩৫:০৫ প্রিন্ট সংস্করণ

কী ঘটেছিল দিল্লির স্টেশনে, কেন প্রাণ গেল ১৮ জনের
ছবি : সংগৃহীত

ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে রেল স্টেশনে পদপিষ্টের ঘটনায় অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকে। এই ঘটনায় নিহত ১৮ জনের যে তালিকা প্রকাশ করেছে প্রশাসন, সেখানে চারজন শিশু এবং ১০ জন নারী রয়েছেন। যাত্রীদের মধ্যে একটা বড় অংশ কুম্ভ মেলায় যাওয়ার জন্য প্রয়াগরাজের ট্রেনে সফর করার উদ্দেশে জড়ো হয়েছিলেন ওই স্টেশনে।

কিন্তু ভিড়ের কারণে পরিস্থিতি একসময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। প্ল্যাটফর্মে হুড়োহুড়ি করার পাশাপাশি ফুট ব্রিজে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এসময় পদপিষ্ট হন অনেকে। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো এবং ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল কি না- এর বাইরে ঘটনার নেপথ্যে যে সমস্ত কারণ রয়েছে তার সব খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে রেলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি রেলের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা, গুরুতর আহতদের জন্য আড়াই লাখ টাকা এবং সামান্য আহতদের জন্য এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

এর আগে গত ২৯ জানুয়ারি, প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভে পদপিষ্ট হয়ে অন্তত ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন অনেকে। সঙ্গমস্থলে ভোর বেলায় স্নানের উদ্দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। সেই সময় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

কী ঘটেছিল?

কুম্ভমেলার কারণে প্রয়াগরাজ যাওয়ার ট্রেনের টিকিটের ব্যাপক চাহিদা ছিল। স্টেশনে একদিকে যেমন কুম্ভ মেলায় যাওয়ার জন্য যাত্রীদের ঢল ছিল, তেমনই অন্য গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রীরাও উপস্থিত ছিলেন শনিবার।

১৪ এবং ১৫ নম্ভর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য যাত্রীরা অপেক্ষা করছিলেন। পাশাপাশি অন্য দু’টো ট্রেন লেট করায় যাত্রীদের সংখ্যা আরও বেড়েছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে ১৩, ১৪ এবং ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বিপুল পরিমাণে যাত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। এরই মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ১৪ ও ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য যে ফুট ব্রিজ ব্যবহার করা হয়, সেখানেও বিপুলসংখ্যক মানুষ ছিলেন। হুড়োহুড়ি শুরু হয়, অনেকে ভারসাম্য সামলাতে না পেরে পড়ে যান।

রুবি দেবী নামে এক যাত্রী বিবিসি হিন্দিকে বলেন, ‘আমরা ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ছিলাম। এত ভিড় ছিল যে আমরা ভেতরের দিকে যেতে পারছিলাম না। ওখানে অনেকের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে। আমরা কোনোমতে বেঁচে গিয়েছি।’

বিহারের পাটনার বাসিন্দা ললিতা দেবী তার ভাগ্নে গিরিধারী সঙ্গে দিল্লি থেকে পানিপথ যাচ্ছিলেন। গিরিধারী বলেছেন, ‘আমরা দু’জনেই প্রথমে পাটনা থেকে এসেছিলাম। নিউ দিল্লি থেকে ট্রেনে করে পানিপথ যাচ্ছিলাম। কিন্তু ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পদপিষ্ট হয়ে মামীর মৃত্যু হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার জন্য স্টেশনে আসা মাত্রই দেখলাম সেখানে প্রচণ্ড ভিড়। সিঁড়িতে ধস্তাধস্তির কারণে আমরা দু’জনে আলাদা হয়ে যাই।’

‘কিছুক্ষণ পর আমি শুনতে পেলাম দুই-তিনজনকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছেন। চাদর দেখে আমি মামীকে চিনতে পারলাম। চাদরটা সরাতেই হালকা একটা নিঃশ্বাস পড়ল।’ কথা বলতে বলতে ভেঙে পোড়েন তিনি।

শনিবারের পরিস্থিতির জন্য প্রশাসনকে দায়ী করেছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে যে পরিমাণে টিকিট বিক্রি হচ্ছিল তাতে রেল কর্তৃপক্ষের আগেই অনুমান করা উচিত ছিল এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

অন্যদিকে, ঘটনার সময় পর্যাপ্ত সাহায্য মেলেনি বলেও যেমন অভিযোগ উঠেছে। তেমনই কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, হঠাৎ ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন করা হয়। যদিও রেল সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

হীরালাল মাহাতো নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘যখন ঘোষণা করা হয় যে ১২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে আসা ট্রেন ১৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসবে, তখন দু’দিক থেকে লোকজন আসতে শুরু করে।’

‘এমন পরিস্থিতিতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। ব্রিজের উপরেই বহু মানুষ আহত হয়েছেন। কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ ছিল না। প্রশাসন এক ঘণ্টা পর এখানে এসেছিল।’

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রবি অবশ্য ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে ছিলাম। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ এই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের লোকজন যখন দেখেন ১৪ ও ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, তখন তারা সকলেই এদিক ওদিক ছুটতে শুরু করেন। ভিড় এত বেশি ছিল যে থামানো যাচ্ছিল না। তবে ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন করা হয়নি।’

‘(অন্য প্ল্যাটফর্মে) ট্রেন দেখা মাত্রই সেখান থেকে লোকজন দৌড়ে আসতে থাকে। ব্রিজের উপরে আরও লোক দাঁড়িয়ে ছিল। ব্যাপক ভিড় ছিল। পুলিশ সব দেখছিল, কিন্তু ভিড় থামাতে পারেনি।’

প্রশাসন কী বলছে?

উত্তর রেলের মুখপাত্র হিমাংশু উপাধ্যায় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘যখন ঘটনাটা ঘটে, তখন ১৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পাটনাগামী মগধ এক্সপ্রেস ও ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে জম্মুগামী উত্তর সংক্রান্তি এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সময়, ১৪ ও ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে যাওয়ার সিঁড়িতে কিছু যাত্রী পা পিছলে পড়ে যান যার ফলে তাদের পিছনে থাকা কয়েকজন যাত্রী ঘটনার কবলে পড়েন এবং এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটে।’

একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি এই ঘটনার তদন্ত করছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

রেল পুলিশের ডিসিপি কেপিএস মালহোত্রা বলেন, ‘কেন হুড়োহুড়ি শুরু হয় এবং পদপিষ্ট হয়, তার সঠিক কারণ তদন্তের পরে জানা যাবে। যে কাজ রেল করবে।’

‘আমরা ভিড় অনুমান করেছিলাম। কিন্তু দু’টো ট্রেন দেরি করায় সেখানে বেশিসংখ্যক মানুষ জড়ো হন এবং এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’

ঘটনার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘রাত ৯টার দিকে ভিড় বাড়তে থাকে। কোনো জায়গায় যখন বেশি মানুষ জড়ো হয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে এবং সেই সময় যদি কোনো ভুল তথ্য ছড়ায়, তাতে পদপিষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এখন, এক্ষেত্রে কেন এমনটা ঘটল, তা জানা যাবে তদন্তের পরে যে কাজ (তদন্ত) করবে রেল।’

পদপিষ্ট হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ডিসিপি মালহোত্রা বলেন, ‘যে ১০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাটা ঘটেছে, সেই সময় বেশিসংখ্যক মানুষ একজাগায় ছিলেন এবং দু’টো ট্রেন দেরিতে চলছিল। তবে এর নেপথ্যে কী ঘটনা রয়েছে, তা রেলের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হবে।’

রাজনৈতিক বিতর্ক

এই ঘটনার জন্য কেন্দ্র সরকারকে দুষেছেন বিরোধী নেতারা। সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ ইয়াদভ। এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, ‘দিল্লিতে মহাকুম্ভ ভক্তদের মর্মান্তিক মৃত্যু হৃদয়বিদারক। সরকারকে রাজনীতিবিদদের মতো নয় বরং একজন পরিবারের সদস্যের মতো করে ভাবতে হবে যিনি তার বাবা-মা, ভাইবোন, সন্তান এবং আত্মীয়স্বজনকে হারিয়েছেন।’

‘নিহতদের মৃতদেহ পূর্ণ সম্মানের সাথে তাদের পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা করা উচিত এবং আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা প্রদান করা উচিত। বিজেপি সরকারের মৃত্যুর বিষয়ে সত্য গোপন করার পাপ করা উচিৎ নয়।’

এর আগে জানুয়ারি মাসে কুম্ভ মেলায় পদপিষ্টের ঘটনাকে কেন্দ্র করেও বিজেপিকে নিশানা করেছিল বিরোধীরা। তাদের অভিযোগ, সেই ঘটনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট তথ্য গোপন করেছে বিজেপি যদিও গেরুয়া শিবির সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

কংগ্রেস নেতা পবন খেরা বলেন, ‘গত রাতে নিউ দিল্লি রেলস্টেশনে যে পদপিষ্টের ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে সরকারের একের পর এক সত্যি উন্মোচিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘গতকাল বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে রেল প্রশাসন এবং রেলমন্ত্রী এই খবর চাপা দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করছিলেন। তিনি ক্রমাগত টুইট করছিলেন যে কেউ পদদলিত হননি, ভিড় বেড়েছে। কিন্তু কেন ভিড় বাড়ল? আপনাদের অব্যবস্থার কারণেই ভিড় বেড়েছে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আরও খবর

Sponsered content