খুলনা

ঝিনাইদহে নদ-নদীতে হচ্ছে ধান চাষ: তীব্র হচ্ছে পানীয় সংকট

  প্রতিনিধি ১৮ এপ্রিল ২০২১ , ৬:২৪:৫৯ প্রিন্ট সংস্করণ

মোমিনুর রহমান মন্টু, ঝিনাইদহ :

প্রচন্ড দাবদাহ আর অনাবৃষ্টির কারনে ঝিনাইদহের মাঠ-ঘাট, বিল-ঝিল, জলাশয়, পুকুর ও নদ-নদীর পানি শুকিয়ে গেছে। ফলে চরম সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে দখলদার আগ্রাসন, পলি জমে ভরাট হওয়াসহ নানা কারনে ঝিনাইদহের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব এখন বিলীন হওয়ার পথে। নদী-নালার তলদেশ শুকিয়ে যাওয়ায় এসব নদীর বুকে এখন ধান, তামাকসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করছেন এলাকার কৃষকরা। দেখে মনে হয় এ যেন বিস্তৃর্ণ ফসলী ক্ষেত। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র মারাতœক হুমকির সম্মুখীন হবে বলছেন পরিবেশবাদীরা।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা ঝিনাইদহে রয়েছে ছয় উপজেলা। এগুলো হলো শৈলকুপা, কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর, মহেশপুর, হরিণাকুন্ডু ও ঝিনাইদহ সদর। জেলার ভেতর দিয়ে নবগঙ্গা, কুমার, বেগবতি, চিত্রা, কপোতাক্ষ, গড়াই সহ বেশকিছু নদনদী প্রবাহিত। তবে একমাত্র গড়াই বাদে সবই এখন মৃত।
জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ১২ টি। এসব নদ-নদীর দৈর্ঘ ৪৮৪.৯০ কিলোমিটার। এসব নদীগুলো এক সময় প্রমত্তারুপে নদীপাড়ের মানুষদের কৃষিকাজসহ জীবন জীবিকার প্রধান মাধ্যম ছিল। চলাচল করতো বড় বড় নৌকা ও জাহাজ। কলকাতার সাথে রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র বিন্দু ছিল এই অঞ্চলের জলপথ। কিন্তু কালের বিবর্তণে পাল্টে গেছে সে চিত্র, এখন আর নদীতে চলে না মালবাহি নৌকা।

বর্ষা মৌসুমে কিছুটা পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুম শুরুতেই শুকিয়ে যায় এসব নদ-নদী। ফলে একদিকে এখানকার জীব বৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে, অন্যদিকে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ঝিনাইদহে হাজার হাজার নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে বিপাকে পড়েছে সাধারন মানুষ। জেলার ছয় উপজেলায় লক্ষাধীক নলকূপে বর্তমানে এমন অবস্থার তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে জেলার শুধুমাত্র শৈলকুপা উপজেলাতেই ৩০ হাজার নলকূপ প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। জেলার কিছু কিছু জায়গাতে পানি মিললেও চলতি মাসের শুরুতে একেবারেই পানিশুন্য হয়ে পড়েছে অনেক নলকূপ।

এছাড়া এক সময়ের প্রবাহমান নদীর বুকে স্থানীয়রা এখন যে যার মত দখল করে চাষ করছে। এক শ্রেণীর প্রভাবশালী মহল প্রতি নিয়তই নদী পাড়ে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে সংকুচিত করে ফেলছে নদীর প্রশস্ততা। এখানেই শেষ না, ময়লা আবর্জনা ফেলে দুষিত করছে নদীর পানি। এতে জীব-বৈচিত্র যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। ঝিনাইদহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নবগঙ্গা নদী। এই নদীকে ঘিরেই জেলার নামকরণ হয়েছিল। কিন্তু খননের অভাবে অধিকাংশ জায়গা শুকিয়ে গেছে, কোথাও কিছুটা পানি থাকলেও দু-ধার দখলে অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে প্রশস্ততা। জেলা সদরের উদয়পুর গ্রামের নদীর অংশে দেখা যায়, শুকিয়ে যাওয়া নদীর মধ্য স্থান দিয়ে যাতায়াতের পথ তৈরি করা হয়েছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীর দু-ধার দখল করে স্থানীয়রা ধানের চাষ করেছেন। কেউবা লগিয়েছে তামাক। অন্যদিকে নদীপাড়ের অবাধে বেড়ে ওঠা ঘাস ব্যবহৃত হচ্ছে গো-খাদ্য হিসাবে।

অথচ এই নদীর প্রস্থতা ছিল এক সময় ৩০০ মিটার। অন্যদিকে, চিত্রা নদীর কালীগঞ্জ উপজেলার মধূগঞ্জ বাজার এলাকা, বেগবতী নদীর বিষয়খালী বাজার অংশ, কুমার নদের গাড়াগঞ্জ অংশসহ প্রায় প্রতিটি নদীর ধারেই পড়েছে দখলদারদের থাবা। ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জেলা শহর সংলগ্ন নবগঙ্গা নদীর কিছু অংশ উচ্ছেদ করা হলেও কয়েকদিন পরেই অদৃশ্য কারনে থেমে যায় সে কার্যক্রম।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকা অনুসারে এখন বিভিন্ন নদ-নদীতে ৬৯ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে তবে বাস্তবে এ সংখ্যা কয়েকগুন বেশী। এছাড়া ১৯৯৩-১৯৯৪ অর্থ বছরের পর আর খনন করা হয়নি বিদ্যমান নদ-নদীর কোন অংশ। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার উদয়পুর গ্রামের মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম জানান, কয়েক বছর আগে দেখলাম কিছু লোক এসে নদী মাফছে। তখন তারা বলেছিল খনন করা হবে। এরপরে আর কোন দিন তাদের দেখলাম না। অপর বাসিন্দা বাবলু মন্ডল জানান, নদী বুজে গেছে। মানুষ যে যার মত পারছে সীমানা মেপে দখল করে খাচ্ছে।

কেউ ধান লাগাচ্ছে, কেউ অন্য চাষ করছে। জেলা পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ কমিটির জেলা সভাপতি মাসুদ আহমেদ সনজু জানান, পরিবেশ, নদী, পানি, প্রাণী একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর কোনটি ক্ষতিগ্রস্থ হলে অপরটির উপর প্রভাব পড়ে। যা পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট করে। আমরা দেখতে পারছি বর্তমান সময়ে নদী পাড়ের বাসিন্দারাই বেশী দখল উৎসবে মেতে উঠছে, তৈরি করছে স্থাপনা। খননের অভাবে ভরাট হয়ে গেছে নদী। এতে পানির অন্যতম উৎস নদ-নদী, জলাশয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধারনা করা হয় বর্তমান সময়ে পানি সংকটের অন্যতম কারন এই জলাশয় নষ্ট হয়ে যাওয়া। এছাড়া নদীকে ঘিরে বেচে থাকা অনেক প্রাণী যেমন কমেছে তেমনি কমেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য অবশ্যই নদী দখল মুক্ত করতে হবে। সথে সাথে অবশ্যই খনন কার্য করে নাব্যতা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে, এছাড়া নদীর যে উৎস্য মুখগুলো আছে সে গুলো পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জাকির হোসাইন জানান, নদ-নদী গুলোর গুরুত্বপুর্ণ পয়েন্ট খননের বিষয়ে বোর্ডে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। সেগুলো অনুমোদন হলেই আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে। আর দখলদার উচ্ছেদ কার্যক্রম সামনের দিনগুলোতে পর্যায়ক্রমে শুরু হবে।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by