প্রতিনিধি ২২ অক্টোবর ২০২৪ , ৪:১৭:৪০ প্রিন্ট সংস্করণ
পটুয়াখালী বাউফলের ঐতিহ্যবাহী বাহারি ডিজাইনের মাটির তৈরি পণ্য সামগ্রী এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের বাজার দখল করেছে এবং আকৃষ্ট করছে বিদেশীদের মন। বিগত কয়েক বছর ধরে ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য।
বাউফল উপজেলার মদনপুরা ও কনকদিয়া ইউনিয়নের পালপাড়ায় সরেজমিনে দেখা যায়, ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা। মৃৎপল্লী ঘুরে চোখে পড়েছে মাটির তৈরী বাহারি সব তৈজসপত্র এবং শোনা যাচ্ছে নানা রং-বেরংয়ের খেলনার টুং টাং শব্দ। বিভিন্ন ধরনের খেলনা সামগ্রী শিশুদের মন কেড়ে নেওয়ার মত।
এ খেলনা সামগ্রী স্থানীয় বাজার বিশেষ করে বৈশাখী মেলায় বেশী বিক্রি হয়।
মৃৎ শিল্পীদর মধ্য প্রতিযোগিতা চলছে দ্রুত সরবরাহের। বাহারি ডিজাইনের পণ্য ফিনিশিং শেষ চলছে প্যাকেজিং। কাগুজিরপুল ব্রিজের ঢালে মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভীড় দেখা যায়। তারা লোড করে নিয়ে যায় মাটির তৈরি পণ্য ভর্তি ঝুড়ি। বাজার ধরতে গাড়িগুলো যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
বাউফল আধুনিক মাটির পণ্য তৈরীর দিকপাল, একাধিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিশ্বেশ্বর পাল জানান, এখানকার মাটির পণ্য দেশ এবং বিদেশে নন্দিত। এ সকল পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য আড়ং, কোর দি জুট ওয়ার্কস, ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট সহ বেশ কয়কটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
তিনি আরো বলেন, প্লাষ্টিক পণ্যের প্রভাব বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা এই পেশা যখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তখন আমরা আধুনিক ডিজাইনের পণ্য তৈরির জন্য কৌশল অবলম্বন করি।
আশির দশকে ঢাকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বাউফলের মাটির পণ্যের মান দেখানো হয়। ওই সময় আড়ং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়। তারা বাউফলে তৈরী মাটির পণ্য দেখে মুগ্ধ হন। সেই থেকেই তাদের সহযোগিতায় এ শিল্প আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। এরপর ঢাকা হ্যান্ডিক্রাফট নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হল এরপর থেকেই ঢাকায় বাউফলে তৈরি নানা ধরণের মাটির পণ্য সরবরাহ শুরু হয়।
তিনি বলেন, আমরা কঠোর পরিশ্রম ও মনোনশীলতা দিয়ে বাউফলের মাটির পণ্যকে বিশ্বমানের আধুনিক পণ্যে রুপ দিতে সক্ষম হয়েছি এবং এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা গর্বের অংশীদার হয়েছেন। বর্তমানে বাউফলের মাটির তৈরী নানা পণ্য এশিয়া মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
বাউফল পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডর সাবেক কাউন্সিলর ও বাউফলের একটি মৃৎ শিল্প কারখানার মালিক শংকর পাল জানান, প্রতিবছরই পণ্যের ডিজাইনে পরির্বতন আসে। ঢাকার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নতুন ডিজাইন করে তাদের চাহিদাপত্র দেন। সে অনুযায়ি নতুন নতুন ডিজাইনের পণ্য তৈরি হয়, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর সবগুলো মাটির পণ্যই নতুনত্ব এসেছে।
অপর এক মৃৎ শিল্পী শ্যামল পাল জানান, এ বছর ডিনার সেটে থাকছে প্লেট, গ্লাস, মগ, কারিবল, জগ, লবনদানি, সানকি (বাসন), কাপপিরিচ ও তরকারির বাটি। এ ছাড়াও নতুন ডিজাইনে তৈরী করা হয়েছে স্যুপ সেট। অন্যান্য পণ্যের মধ্যে নতুন ডিজাইনের কয়লাদানি, মোমদানি, ঘটি, ফুলদানি ও নানা ধরণের খেলনা ক্রেতাদের আলাদা ভাবে আকৃষ্ট করবে। ডিনার সেট ছাড়াও আলাদা বিক্রির জন্য তৈরী করা হয়েছে মাটির প্লেট, গ্লাস, জগ, মগ, ইত্যাদি। রাসায়নিক কোন পদার্থের ছাঁয়া ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে মাটির ওইসব পণ্য। পণ্যের গায়ে রঙ করা হয় পাহাড়ি গাছের রস দিয়ে।
মৃৎ শিল্পের সাথে জড়িত সীমা নামের একজন জানান আমরা অনেকেই এখানে কাজ করি এতে অনেকে বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।
মৃৎ শিল্প কারখানার মালিক ও দি পটুয়াখালী চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য শিল্পী বরুন পাল জানান এক সময় বাউফলের পাল পাড়ায় জালের কাঠি, পুতুল, কলস, বাচ্চাদের খেলনা, রসের হাঁড়িসহ গ্রামবাংলার ঘর ব্যবহার্য নানা ধরণের মাটির সামগ্রী তৈরী হত। ক্রমান্বয়ে প্লাষ্টিক সামগ্রীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একই কাঁচামালে তৈরি হত মোমদানি, অ্যাষ্ট্রে, ফুলদানি এবং পায়ের গাড়ালি ঘেষানি (ঝোমা), ডিনার সেট, মোমদানি, কয়েল দানি, টি সেট, হুক্কা, ভর্তার বাটি, ল্যাম্পসেট, মাটির মালা, ব্রেসলেট ও কানের দুলসহ আর্কষনীয় মাটির শোপিচ।
তিনি জানান, আধুনিক ডিজাইনের এসব মাটির পণ্য তৈরি করে অনেক পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছে।
রতন নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের এখান থেকে নদী অনেক দূরে থাকায় মৃৎ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল মাটি সংগ্রহ কঠিন তাই বিভিন্ন এলাকা থেকে চুক্তিতে মাটি ক্রয় করেত হয় চড়া দামে। যদি আমরা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাই তাহলে এই শিল্পকে আরোও সমৃদ্ধ করতে পারব।