দেশজুড়ে

শরীয়তপুরে বৃক্ষ মেলার নামে চলছে তামাসা

  প্রতিনিধি ৭ জুলাই ২০২৪ , ৬:৪২:০৮ প্রিন্ট সংস্করণ

শরীয়তপুরে বৃক্ষ মেলার নামে চলছে তামাসা

শরীয়তপুরে বৃক্ষ মেলার নামে চলছে তামাসা। জেলার গোসাইরহাট উপজেলায় দশদিন ব্যাপী বন বিভাগের বৃক্ষমেলা শুরু হয়েছে।এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান শরীয়তপুর বন বিভাগ। বৃক্ষমেলার মাঠ জুড়ে দেখা যায় প্রসাধনী ফুসকা-চটপটিসহ বিভিন্ন পসরার দোকান।

অন্য দিকে মেলার এক কোণে একটি মাত্র গাছের চারা বিক্রির দোকান দেখতে পাওয়া যায় । মেলায় আগত দর্শকরা এই মেলাকে বলছেন গাছের সঙ্গে তামাসা, আবার কেউ বলছেন বৈশাখী মেলা বা বাণিজ্য মেলা। বৃক্ষমেলার মূল ফটকে মেলার আয়োজক বন বিভাগ লেখা থাকলেও বন বিভাগ জানিয়েছে তারা কোনো মেলার আয়োজন করেনি।

উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় বৃক্ষমেলার আয়োজন করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সচেতন মহল এই মেলাকে বৃক্ষমেলা হিসেবে মানতে নারাজ। শুক্রবার (৫ জুলাই) গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এমন একটি বৃক্ষ মেলা দেখতে পাওয়া যায় ।

জানা যায়, নাগরিকদের মধ্যে বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করতে ‘আজকের গাছ আগামি দিনের ভবিষ্যৎ’ স্লোগানকে সামনে রেখে বৃক্ষমেলার আয়োজনকে, গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিল উপজেলাবাসী। কিন্তু পহেলা জুলাই থেকে শুরু হওয়া দশদিন ব্যাপী বৃক্ষমেলার চিত্র দেখে আশাহত হয়েছেন উপজেলাবাসী।

মেলার ঘুরে দেখা যায় , মেলায় ৩৯ টি দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে । বিভিন্ন মুখরোচক খাবার ফুসকা-চটপটি, কসমেটিকস, প্রসাধনীসহ শিশুদের খেলনার বিভিন্ন রাইড দিয়ে সাজানো ৩৮টি দোকান, এক কোণে পড়ে রয়েছে মান্নান নার্সারী নামে একটি গাছের চারা বিক্রির দোকান।গাছের চারা বিক্রির ওই দোকানটিতে চলছে বিক্রির খরা।

মেলার অন্যান্য দোকান মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায় , সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তাদের গড় বিক্রি প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। উপজেলা প্রশাসন বৃক্ষমেলায় আসা দোকান মালিকদের কোনো ভাড়া দিতে হয় না বলে জানালেও দোকানদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন প্রতিদিন ১ হাজার বা তার চেয়ে কিছু কমবেশি ভাড়া দিতে হয় আয়োজক কমিটিকে।

এমন বৃক্ষমেলার প্রধান ফটকে আয়োজক বন বিভাগ শরীয়তপুরের নাম লেখা থাকলেও গোসাইরহাটে এমন কোনো বৃক্ষমেলা বন বিভাগ আয়োজন করেনি বলে জানিয়েছে বন বিভাগ। কিন্তু গোসাইরহাট উপজেলা প্রশাসন বলছে মেলাটির আয়োজক বন বিভাগ, সার্বিক সহযোগিতা করেছে উপজেলা প্রশাসন।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এই মেলা দিয়ে উপজেলায় বৃক্ষরোপণের কোনো উপকার হবে না। বরং মানুষ গাছের চারা রোপণ করার জন্য যে টাকা বরাদ্ধ রেখেছিল, সেই টাকায় বৃক্ষমেলা থেকে কসমেটিকস, প্রসাধনী কিনে আঁচার-ফুসকা খেয়ে বাড়ি যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানদার বলেন, দশদিন ব্যাপী এই মেলায় বৃষ্টির কারণে তেমন বিক্রি হচ্ছে না। কিন্তু প্রতিদিন এক হাজার টাকা ভাড়া দিতে হবে মেলা আয়োজক কমিটিকে। বিক্রি না হলে দশদিনে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে তেমন লাভ হবে না আমাদের।

মেলার একপাশে রয়েছে ভূতের বাড়ি। শিশুদের বিনোদনের এই ভুতের বাড়ির আয়োজন করা হয়েছে। ভুতের বাড়ির কর্মচারী জাকির বলেন, আমি প্রতিটি টিকেট ৪০ টাকায় বিক্রি করি। প্রতিদিন ১০ হাজার টাকার বেশি বিক্রয় হয়। ভাড়ার বিষয়টি মালিক পক্ষ জানে, আমি এবিষয়ে কিছুই জানি না।

মেলার একমাত্র নার্সারীর দোকান কর্মচারী নাজমুল জানান , মানুষ এখন আর আগের মতো গাছ কিনে না। দোকানে এসে মানুষ গাছের নাম ও দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়। অধিকাংশ মানুষ মেলার নৌকা ও নাগরদোলায় চড়ে আনন্দ করে, গাছ কিনে না। তবে কেউ কেউ গাছ কিনে। গাছের প্রতি মানুষের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। আজ শুক্রবার তেমন বিক্রি হয়নি। গতকাল পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি।

নার্সারিটির মালিক মো. মান্নান হাওলাদার বলেন, আমার মূল নার্সারী মাদারীপুরে। তবে একটি বাগান শরীয়তপুরের পশ্চিম কোটাপাড়া এলাকায়ও রয়েছে। বৃক্ষমেলায় একটি মাত্র গাছের চারা বিক্রির দোকান, বিষয়টি তেমন ভালো দেখায় না। অন্যান্যদেরও আসতে বলা হয়েছিল, তবে তারা আসেননি।

শাহানা নামে একজন ক্রেতার সাথে কথা হয় তার প্রশ্ন, মেলায় গাছের চারার দোকান আছে? থাকলে দোকানটি কই? তাকে দোকানটি দেখিয়ে দিলে তিনি বলেন, এটা কখনো বৃক্ষমেলা হতে পারে না।

বৃক্ষ মেলা উপলক্ষ্যে মেলায় এসেছেন মো. জামশেদ বেপারী তিনি বলেন, আমি গতকালকেও মেলায় এসেছিলাম। আমার কাছে বিষয়টি অস্বস্তিকর লাগছে । ভেবেছিলাম মেলায় বিভিন্ন ধরনের অনেক গাছ পাওয়া যাবে। দেখলাম তেমন গাছ নেই। মনে হয় বাণিজ্য মেলায় এসেছি। এই মেলাটি উপজেলাবাসীর জন্য কোনো সুখবর না। কারণ, বৃক্ষমেলায় বৃক্ষই নেই।

গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান ঢালী বলেন, আপনাকে ধন্যবাদ এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখার চিন্তা করায়। আমি শেষ কর্মদিবস ৩০ জুন দেখেছি ইউএনও মহোদয় মাঠে মেলার জন্য দোকান নির্মাণ করছেন। কিন্ত জানতাম না, এখানে কিসের মেলা হবে। বৃক্ষমেলায় সাধারণত গাছের চারা বিক্রি হওয়ার কথা। মেলায় একটি মাত্র নার্সারীর দোকান এ কেমন বৃক্ষমেলা! বিষয়টি উপজেলাবাসীর জন্য লজ্জ্বার ও দুঃখজনক। এটা বৃক্ষমেলা হতে পারে না।

বৃক্ষমেলার বিষয়ে কিছুই জানেন না নবনির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান এমদাদ হোসেন বাবলু মৃধা। তিনি বলেন, আমি ঢাকায় ছিলাম। মেলা কোথায় হচ্ছে, কীসের মেলা হচ্ছে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

এ বিষয়ে শরীয়তপুর বন বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, মূল ফটকে কী লেখা রয়েছে তা আমার জানা নেই । গোসাইরহাটে মেলা করার জন্য বন বিভাগের কোনো বরাদ্দ নেই। কোনো আয়োজনও বন বিভাগ করেনি। নার্সারী মালিক সমিতির আবেদনের পরে একদিন মিটিংয়ে জেলা প্রশাসন বলেছিল উপজেলা প্রর্যায়ে বৃক্ষমেলা মেলার আয়োজন করার জন্য।

সেদিন মেলার জন্য আমাদের কোন বরাদ্দ নেই বলে আমরা জানিয়েছিলাম। গোসাইরহাটে বৃক্ষমেলার আয়োজন হয়ত উপজেলা প্রশাসন করেছে। আয়োজকের স্থলে বন বিভাগের নাম তারা হয়ত ভুলে লিখেছে। বৃক্ষমেলার নামে ৩৯ টি দোকানের মধ্যে একটি মাত্র দোকান গাছের চারা বিক্রি করার, বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মো. সালাহ উদ্দিন বলেন, এই বিষয়টির ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না, আপনি উপজেলা প্রশাসনের সাথে কথা বলুন।

বৃক্ষমেলা নিয়ে গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আহমেদ সাব্বির সাজ্জাদ বলেন, মেলাটি বন বিভাগ আয়োজন করেছে, তা মূল ফটকে লেখা রয়েছে। মেলাকে সার্বিক সহযোগিতা করছে উপজেলা প্রশাসন। আর ভাড়া নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ সরকারি মাঠে মেলা করতে আবার কীসের ভাড়া? উর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমতি ছাড়া তিনি আর কোনো প্রশ্ন শুনতে বা বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ।

আরও খবর

Sponsered content