প্রতিনিধি ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ , ৬:২৭:১৯ প্রিন্ট সংস্করণ
ভোলার চর সামাইয়া ইউনিয়নের যে নারীরা এক সময় অন্যের বাড়ীতে গৃহকর্মীর কাজ করতো,কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় জড়িত থাকলেও এখন তা আর নেই। ঐসব পেশা ছেড়ে এখন তারা সফল উদ্যোক্তা। তারা এখন কর্ম করে খায়। ক্ষুদ্র শিল্প বদলে দিয়েছে তাদের গ্রামীন জীবন। একদিকে যেমন সংসারের কাজকর্ম করছেন পাশাপাশি হোগলাপাতার দড়ি বানিয়ে উপার্জনে হচ্ছেন স্বাবলম্বি।
চরসামাইয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এই গ্রামের নারীদের একটি অংশ শুকনা হোগলা পাতাকে পানিতে ভিজিয়ে নরম করে চুলের বেনীর মত মুড়িয়ে মুড়িয়ে তৈরি করা হয় দড়ি। আড়ৎদাররা কয়েকদিন পর পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করে ঢাকার বিভিন্ন শিল্প কারখানায় পাঠানো হয়। এসব কারখানায় এ দড়ি দিয়ে তৈরি হয় মোড়া, চেয়ার, কলস, জগ, ফুলদানি, ব্যাগসহ নানা রকমের আসবাবপত্র ও শো-পিস। এ শিল্প এখন চরসামাইয়া ইউনিয়নেই সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে। এখানকার শতাধিক নারী ও স্কুল কলেজে পড়ুয়া মেয়েরা হোগলা পাতার দড়ির শিল্পে কাজ করে এখন তারা এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।
চরসামাইয়ার বাসিন্দা জসিম, ফরিদ, রহিম, রশিদ মিয়া, লালু মিয়া, কাঞ্চন ব্যাপারী জানান, বিভিন্ন চর থেকে হোগলা পাতা এনে তারা নারী শ্রমিকদের হাতে তুলে দেন। তা দিয়ে নারীরা দড়ি তৈরি করে। প্রতি ১০০ হাত দড়ি তৈরির মজুরি ১৪ টাকা। এসব দড়ি ২০ টাকা দরে সাভার ও গাজীপুরে সাপ্লাই দিচ্ছেন তারা। এতে ভাল আয় হচ্ছে তাদের। দিনদিন এ কাজের উৎস গড়ে ওঠায় এসব গ্রামগুলোতে অভাবও কমে এসেছে।
তারা এখন স্বচ্ছল,স্বনির্ভর। ভাগ্যবদলের সংগ্রামে নেমে এখন তারা পূরনো সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। পুরানো সেই পেশাতে এখন আর তারা নেই । এখন আর তাদের কুঁড়ে ঘর অথবা জড়াজীর্ণ বাড়িতে থাকতে হয় না। তারা এখন খেয়ে পুড়ে সন্তানদের লেখা পড়া করাচ্ছেন স্কুল কলেজে। পরিশোধ করছেন এনজিওর কিস্তির আর দীর্ঘদিনের জমে থাকা ধারদেনার টাকা। এখন স্বচ্ছলাতায় তাদের জীবন। দেখছেন আগামীর ব্যাপক স্বপ্ন। হোগলা পাতার দড়ি বানিয়েই বদলে গেলো তাদের জীবন।
চরসামাইয়া গ্রামের নারী উদ্যোক্তা ইয়ানুর (৩৫)বলেন, আমরা যদি আর একটু বেশি মজুরি পাইতাম তবে সব কাজ ফালাইয়া দড়ি বানাইতাম। এক আটি দড়ি বানাইতে অনেক কষ্ট। এক আটিতে ৬৫০ টাকা দেয়।
আরেক নারী উদ্যোক্তা রহিমা বেগম বলেন,দড়ির কাজ আছে দেইখাই অন্যের বাড়ীতে বুয়ার কাজ করা ছাইরা দিছি। দড়ি বিক্রি করে মাসে ৫/৭ হাজার টাকা রোজগার করি। তা দিয়া সংসার খরচ, পোলাপানের স্কুলের খরচ এবং সমিতির কিস্তি দিয়া আল্লাহ ভালোই রাখছেন এহন।
জানা যায়, উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে হোগলার দড়ি সংগ্রাহক ব্যবসায়ী আমির হোসেন বলেন, আমরা দাঁদন দিয়া চর রাহি,পাতা কাটি রোইদে সুখাইয়া মহিলাদের দেই। তাদেরকে প্রতি আটিতে ৬৫০ টাকা দেই। এ দড়ির তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা দেশের সবখানেই রয়েছে। এখানে তৈরি করে সরাসরি বিদেশে পাঠানো গেলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত।
ব্যবসায়ী মজনু বেপারী বলেন, আমরা বিভিন্ন এলাকার পাতার মালিকদের অগ্রীম টাকা দিয়ে চর রাখি। সেই চরের কাঁচা পাতা কেটে রোদে শুকিয়ে শ্রমিকদের দেই। তারা দড়ি বানিয়ে আমাদেরকে দেয়। প্রতি ১শ’ হাত দড়ি ১৪ টাকা দরে ক্রয় করি। এই দড়ি আমরা ঢাকার সাভার ও গাজীপুরে কুটির শিল্প তৈরির কোম্পানির কাছে পাঠাই। তাদের কাছে প্রতি ১শ’ হাত ২০টাকা দরে বিক্রি করি। অনেক আগে কিছু শ্রমিককে ঢাকায় নিয়ে বিভিন্ন শো-পিস তৈরির কাজ শিখাইছি। কিন্তু বিদেশে রপ্তানির সুযোগ এখনো আমরা পাইনি। যদি সরকার অথবা পুঁজি বিনিয়োগকারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা পাই তবে ভোলায় রপ্তানিমূখী কুটিরশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব এবং এখান থেকে সরাসরি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সহ প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।
এ ব্যাপারে ভোলা বিসিক শিল্পনগরীর উপ-পরিচালক মোঃ সোহাগ আহাম্মদ বলেন,ভোলাতে হোগলা পাতা দিয়ে দড়ি তৈরি করা হয়। এর পাশাপাশি হোগলা পাতা দিয়ে বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। এতে করে গ্রামের অনেক মহিলাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। আমি সরেজমিনে অনেক জায়গা পরিদর্শন করেছি, তাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের মতামত জেনেছি।
তিনি বলেন, এখানে বিশাল সম্ভাবনার খাত এটা। এখানে যারা জড়িত রয়েছে বা যে সকল উদ্যোক্তা আছে তাদেরকে যদি উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়া যায় এবং বিনিয়োগের পরিমাণটা যদি বাড়ানো যায় দেশের মধ্যে বড় একটা বাজার তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ পণ্য বিদেশে রপ্তানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। ‘আমরা দড়ি তৈরির বিষয়টি অবগত আছি। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দড়ি ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছি।
এ ব্যাপারে ভোলা জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান জানান, ভোলার তৃণমূল নারী ও পুরুষ উদ্যোক্তাদের পার্শ্বে সরকারের সহায়তার হাত সবসময়ই প্রশস্ত রয়েছে। জেলা সদর ভোলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিল্পদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের বহু পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।