উপ-সম্পাদকীয়

গ্লোবাল ক্রাইসিস : বৈশ্বিক মন্দা ও উষ্ণতার মহাসড়কে বিশ্ব

  প্রতিনিধি ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ , ৪:৪৪:২০ প্রিন্ট সংস্করণ

মো. খবির উদ্দিন : পৃথিবী মন্দা ও উষ্ণতার মহাসড়কে। এই মন্দা ও উষ্ণতা মানবসৃষ্ট। মানব সম্প্রদায় যখন পৃথিবীর স্বাভাবিক পরিবেশের উপরে বিরূপ আচরণ করে তখন পৃথিবীও পরিবেশ বিপর্যয়ের মাধ্যমে এর প্রতিদান দিয়ে দেয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সামুদ্রিক ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা, খরাসহ নানামুখী সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে খাদ্য উৎপাদন ও অর্থনীতির চাকা তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলছে। দীর্ঘ সময় করোনার কারণে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল গোটা বিশ্ব। মানসিক চাপে পড়ে গিয়েছিল মানব সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক চাকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল গোটা বিশ্বে পরস্পরের। আন্তর্জাতিক আমদানি-রপ্তানি স্থবির হয়ে পড়েছিল। ব্যবসায়ীদের মুখে শোনা যেত এই পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাটাই বড় ব্যবসা।
অর্থনীতিবিদ্যা অনুযায়ী দীর্ঘ সময় ধরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ধীরগতি অথবা বাণিজ্যিক আবর্তন-এর সংকোচনকে মন্দা বলা হয়। মন্দার সময় বড় অর্থনৈতিক সূচকগুলোর ধরন একই রকম থাকে। মন্দার সময় জাতীয় গড় আয় (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা এউচ), চাকরি, বিনিয়োগ সংক্রান্ত ব্যয়, উৎপাদন ক্ষমতার ব্যবহার, পারিবারিক আয়, ব্যবসায়িক লাভ- এ সব কিছুই অনেক কমে যায়, মুদ্রাস্ফীতি ঘটে (একই অর্থ ব্যয় করে কম পরিমাণ দ্রব্য ক্রয় করতে হয়), এই সময় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। অনেক অর্থনীতিবিদ ১২ মাসের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ ১.৫% বৃদ্ধিকে মন্দার সংজ্ঞা বলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ (ঘইঊজ) এর মতে, “কয়েক সালের বেশি সময় ধরে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যেমন- প্রকৃত জাতীয় আয়, প্রকৃত ব্যক্তিগত আয়, চাকরি, শিল্প উৎপাদন এবং পাইকারি খুচরা বিক্রয় ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য হ্রাস দেখা দিলে তাকে মন্দা বলা হয়।”

বিশ্বব্যাপী মন্দার কোনও সাধারণভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড ওগঋ এর বক্তব্য অনুসারে বিশ্বের বিকাশ যখন ৩০% এর কম তখন সেই পরিস্থিতিকে বিশ্বব্যাপী মন্দা বলা যায়। ওগঋ এর আনুমানিক হিসাব অনুসারে ৮ থেকে ১০ বছরের এক-একটি চক্র অন্তর বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দেয়। গত তিন দশক ধরে ওগঋ যে তিনটি মন্দাকে বিশ্বব্যাপী মন্দা আখ্যা দিয়েছে, সেই ক্ষেত্রগুলোতে বিশ্বজুড়ে মাথাপিছু উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল শূন্য বা ঋণাত্মক।

বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলছে। গত ১৫.০৯.২০২২ বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়- বিশ্বে অর্থনৈতিক শক্তির দিক দিয়ে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপ। এই তিন শক্তির অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি হারাচ্ছে। এর মধ্যে আগামী বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর মাঝারি কোনো আঘাত এলেও তার পরিণতি গড়াতে পারে মন্দায়। এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলো। অর্থনীতিবিদদের মতে, ১৯৭০ সালের মন্দার পর বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন সবচেয়ে সংকটে রয়েছে। আর আগের মন্দা শুরুর আগে মানুষের ব্যয়ের যে প্রবণতা ছিল, সে তুলনায় বর্তমানে মানুষ অনেক কম খরচ করছে।

বিশ্ব মন্দা হলে রপ্তানির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার মন্দা হলে জ্বালানি তেলের দাম হয়তো কিছু কমবে, বিশ্ববাজারে পণ্যের দরও কমবে, যা বাংলাদেশের জন্য ভালো দিক। তবে বৈশ্বিক সুদহার বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বা বিদেশি পুঁজি ব্যয়বহুল হবে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ বেড়ে যাবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস এ নিয়ে বলছেন, বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমে আসছে। ভবিষ্যতে যখন বিভিন্ন দেশ মন্দার কবলে পড়বে, তখন এই গতি আরও কমে আসতে পারে। ডেভিড ম্যালপাসের শঙ্কা, প্রবৃদ্ধি কমে আসার যে হাওয়া বইছে, তা অব্যাহত থাকবে। এর মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোকে।
বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য বলছে, সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয় তাহলে ২০২৩ সালে জ¦ালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এই অংকটা করোনা মহামারির আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার অতিরিক্ত ২ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। তবে চলতি বছরেই এরই মধ্যে এ হার গড়ে ২ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছে তারা। বিশ্বব্যাংক বলছে একে তো চলছে অর্থনৈতিক সংকট, তারপর সুদের হার বৃদ্ধির এই পরিমাণ ২০২৩ সালে বিশ্বে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ মাথাপিছু আয় সংকোচন করতে পারে। ডেভিড ম্যালপাস এর সমাধান স্বরূপ মনে করেন, নীতিনির্ধারকদের আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে তাঁদের বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে, বাড়াতে হবে উৎপাদনশীলতা।
ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া ২৭তম জলবায়ু সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, জলবায়ু বিপর্যয়ের মহাসড়কে চলছে বিশ্ব এবং এগিয়ে চলছে দ্র”তগতিতে। মিশরে জড়ো হওয়া বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখন শুধু দু’টি পথ খোলা আত্মহত্যা নয়ত সমন্বিত পদক্ষেপ। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ টোয়েন্টি সেভেনে অংশ নিতে মিশরে জড়ো হয়েছে প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা। তাদের লক্ষ্য, জলবায়ু বিপর্যয় থেকে ধরিত্রীকে রক্ষার সমন্বিত পদক্ষেপ। জীবাশ্ম জ¦ালানির উপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের আহ্বান উঠে এসেছে বিশ্ব নেতাদের কণ্ঠে। জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনায় এবার প্রথমবারের মত এজেন্ডা হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে ক্ষতিপূরণ তহবিল। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে অবধারিতভাবেই উঠে এসেছে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব।

ঘঅঝঅ ঊধৎঃয ঙনংবৎাধঃড়ৎু এর তথ্য মতে, ১৯৫১-১৯৮০ এর তুলনায় ২০০০-২০০৯ পর্যন্ত ১০ বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি নির্দেশ করছে। সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে উত্তর এবং দক্ষিণ গোলার্ধে। কৃত্রিম উপগ্রহকৃত তাপমাত্রা পরিমাপ হতে দেখা যায় যে, নিম্ন ট্রপোমন্ডলের তাপমাত্রা ১৯৭৯ থেকে প্রতি দশকে ০.১২ ডিগ্রি সে.-০.২২ ডিগ্রি সে. সীমার মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৫০ সালের এক বা দুই হাজার বছর আগে থেকে তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ছিল, তাছাড়া সম্ভবত মধ্যযুগীয় উষ্ণ পূর্ব কিংবা ক্ষুদ্র বরফযুগের মত কিছু আঞ্চলিক তারতম্য ঘটেছিল।
সৌরমন্ডলে পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটার ও তা টিকে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ নেই। মূলত বাতাস ও পানির উপস্থিতির কারণেই আমাদের এই পৃথিবী অন্যান্য গ্রহের চেয়ে এতটা আলাদা। পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠকে ঘিরে রেখেছে বায়ুমন্ডলের পাতলা একটি স্তর। এই বায়ুমন্ডলের ৭৮ শতাংশ নাইট্রোজেন ও ২১ শতাংশ হলো অক্সিজেন। বাকি শতকরা ১ ভাগের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্গন, মিথেন, ওজোন, সালফার ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি অসংখ্য বায়বীয় পদার্থ, আর পানি ও কণাপদার্থ। সূর্যরশ্মির অধিকাংশই ভূমন্ডলে প্রবেশ করে; কিন্তু এর কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠে ও বায়ুস্তরে প্রতিফলিত হয়ে মহাকাশে ফিরে যায়। সূর্যের আলো যতটুকু বায়্মুন্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে পৌঁছায়, এর একটি অংশ ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে তোলে। তারপর ভূপৃষ্ঠ ঠান্ডা হতে থাকে, তখন শোষিত তাপটুকু অবলোহিত রশ্মি হিসেবে বায়ুমন্ডলে বিকিরিত হয়।
পৃথিবীর বায়ুস্তরে কিছু গ্যাসীয় উপাদান ও কণাপদার্থ আছে। এগুলো বিকিরিত তাপকে শুষে নেয় এবং ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুস্তর অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারকে উষ্ণ করে তোলে। আর এই প্রক্রিয়াই পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী উষ্ণতা বজায় রাখে এবং জীবজগৎকে সুরক্ষিত রাখে। ঠিক একটি গ্রিনহাউসের মতো। এককথায় একেই বলে গ্রিনহাউস এফেক্ট। আর তাপ শোষণ ও ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা পালন করে বলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, জলীয় বাষ্প, ওজোন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি বায়বীয় পদার্থকে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নামে ডাকা হয়।
বর্তমানে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রিনহাউস এফেক্ট যদি না থাকত, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা হতো মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাই যদি হতো পৃথিবীর বুকে তরল আকারে পানির অস্তিত্ব থাকত না। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের গঠন ও গ্রিনহাউস এফেক্টে সেটা হয়নি। আর এ কারণেই পৃথিবীর বুকে লাখ লাখ জীবনের উদ্ভব ঘটে চলেছে এবং তারা টিকেও থাকতে পারছে।

গ্রিনহাউস প্রভাবের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহের বা বিতর্কের অবকাশ নেই। অর্থাৎ গ্রিনহাউস এফেক্টের অনুপস্থিতিতে জীবনের অস্তিত্বই অসম্ভব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমন্ডলের অধিক তাপশোষী কিছু গ্রিনহাউস গ্যাস ও কার্বন কণার (যেমন ব্ল্যাক কার্বন) পরিমাণ বেড়েই চলেছে। শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে কলকারখানা থেকে নিঃসৃত ধোঁয়ার পরিমাণ বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা, সার্বিক জীবনযাত্রার মান ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আগ্রহ। নগরসভ্যতা বিস্তারের পাশাপাশি যানবাহন ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল ও শিল্পকারখানায় উৎপাদন নিশ্চিত করতে যথেচ্ছভাবে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামজাত জীবাশ্ম জ¦ালানি। এতে উপজাত হিসেবে তৈরি হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও ব্ল্যাক কার্বনের মতো তাপশোষী গ্যাসীয় ও কণাপদার্থ। এসব উপজাত প্রতিমুহূর্তে বাতাসে মিশে যাচ্ছে প্রচুর পরিমাণে। এদিকে কৃষিকাজ, পশুচারণ, নগরায়ণ ও আরও নানা উদ্দেশ্যে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করার মতো গাছপালার সংখ্যাও আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। আর এভাবেই বায়ুমন্ডলের গড় উষ্ণতা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। এই বিষয়টিকে এককথায় বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।

গবেষণায় পাওয়া তথ্য, উপাত্ত ও মডেলনির্ভর জটিল হিসাব-নিকাশে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮০ সাল অর্থাৎ, শিল্পবিপ্লবের কিছু কাল পর পর্যন্তও বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ২৬০-২৮০ পিপিএমের (পার্টস পার মিলিয়ন) মধ্যে ওঠানামা করেছে। কিন্তু ১৯৮৯ সাল নাগাদ সেই মাত্রা নিরাপদ সীমা (৩৫০ পিপিএম বা মিলিগ্রামে পার লিটার) ছাড়িয়ে গেছে। সঙ্গে পৃথিবীর বার্ষিক গড় তাপমাত্রাও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিককালে প্রতিটি বছরই তার আগের বছরের তুলনায় বেশি উষ্ণ হয়ে উঠেছে। তবে মনে রাখা দরকার, বৈশ্বিক উষ্ণতার সঙ্গে ওজোন স্তরে ক্ষয়ের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঘটে বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে ১৪ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে এই পরিবর্তন সীমাবদ্ধ থাকে। আর ওজোন স্তরের অবস্থান হচ্ছে বায়ুমন্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারের সংলগ্ন এর পরের স্তর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে অর্থাৎ, ১৪ থেকে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়। মূলত মানুষের তৈরি ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের ফটোকেমিক্যাল বিক্রিয়ার কারণে ওজোন স্তরে ক্ষয় হয়।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে সামুদ্রিক ঝড় বেড়ে গেছে। পৃথিবীর শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা হচ্ছে। আর আর্দ্র অঞ্চলগুলো হয়ে পড়ছে আগের চেয়ে শুষ্ক। এ ধরনের পরিবর্তনগুলোকে এককথায় বলা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফস্তর বা হিমালয়-আল্পসের মতো পর্বতমালার হিমবাহ অথবা সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল খন্ডগুলো গলে যাচ্ছে। গবেষকগণ ও পরিবেশবিদেরা বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধে জীবাশ্ম জ¦ালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করছেন এবং মানব সচেতনতা, গাড়ির ধোঁয়া, কারখানার ধোঁয়া ইত্যাদি রোধ, সিএফসি নির্গত হয় এমন যন্ত্রপাতির ব্যবহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা এভাবে বাড়তে থাকলে ২০৩০ সালের পর থেকে পৃথিবীর সাগরগুলোর পানির লেয়ার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে শুর” করবে এবং সাগর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলোতে নোনা পানি ঢুকতে শুরু করবে। পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে জনপদগুলো পানির নিচে তলিয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে কৃষিজমি ও জীববৈচিত্র্য। বাংলাদেশের দক্ষিণের একটি বিরাট অঞ্চল এ ঝুঁকিতে রয়েছে। ভবিষ্যতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনের পুনর্বাসন ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

বৈশ্বিক মন্দা ও বৈশ্বিক উষ্ণতার মহাসড়ক থেকে পৃথিবীকে ঊনিশ শতাব্দির আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে হলে বিশ্ব নেতৃত্বের সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা উপায় খুঁজে নিতে পারি। পৃথিবীর সকল মানুষের অভিন্ন অস্তিত্ব ভেবে পরস্পরের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। হয় সমন্বিত পদক্ষেপ নয়ত আত্মহত্যা বিষয়টি নিশ্চিত জেনে পৃথিবীর সকল নেতৃত্ব কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করলে আমরা অবশ্যই এই বৈশ্বিক মন্দা ও উষ্ণতা থেকে পরিত্রাণ পাব ইনশাআল্লাহ্।

লেখক : কলামিস্ট
[email protected]

Powered by