ঢাকা

“পুলিশের ইউনিফর্ম আমার অহংকার”পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা

  প্রতিনিধি ৮ মার্চ ২০২৩ , ৭:৩৭:৫৮ প্রিন্ট সংস্করণ

কে এম সাইফুর রহমান, গোপালগঞ্জঃ 

পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা, বিপিএম, পিপিএম, বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যদের জন্য একটি প্রেরণার বাতিঘর বললে হয়তো বা ভুল হবে না। এই নারী অফিসার বর্তমানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেলা গোপালগঞ্জে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন। এই নারী অফিসার মেধা, যোগ্যতা, সাহসীকতা ও দক্ষতার প্রমান দিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে কাজ করে চলেছেন। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ ও মাদককারবারীদের বিরুদ্ধে “জিরো টলারেন্স” ভূমিকায় থেকে বিভিন্ন দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিচ্ছেন দিনের পর দিন। পাশাপাশি অগ্রিম গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় অবদান রাখছেন তিনি। কাজ করছেন নারী নির্যাতন, পাচার ও বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, একতরফা তালাকের ক্ষেত্রে দেনমোহর ও খোরপোষ আদায় এবং যৌতুক সহ বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার বিরুদ্ধে। পেশাদারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতায় স্বপ্রনোদিত হয়ে শিক্ষার্থীসহ সমাজের অংশিজনের মাঝে নারী ও শিশু নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে অহর্নিশ কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন নারীরা মেধা, যোগ্যতা, পরিশ্রম, নিষ্ঠারজোরে সকল বাঁধা পেরিয়ে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছে যেতে সক্ষম। চোখে মুখে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার স্বপ্ন তার। অপরাধ দমনে নারীরা যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে নেই, তারাও যে সফল হতে পারে সেই দৃষ্টান্তই রাখলেন তিনি। ২৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকুরী জীবনের প্রতিটি ধাপে কঠোর পরিশ্রম আর নিয়মানুবর্তিতার মাধ্যমে সফলতার পরিচয় দিয়ে আজ তিনি গোপালগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে সফলতার মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে জেলার সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণনে রেখেছেন। তার কর্মকালীন সময়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। তার সার্বক্ষনিক তদারকি ও দিক নির্দেশনায় ফৌজদারী অপরাধ অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে এবং উদ্ধার জনিত মামলার সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে পুলিশের প্রতি আস্থা বেড়েছে বহুগুন। আঠারো বছরের কর্মজীবনের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে  তিনি রেখেছেন পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর।

মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক নানা সমস্যার সম্মুখিন হলেও কখনোই পিছু পা হননি তিনি। একশ্রেণীর অসংবেদনশীলতা ক্রমান্বয়েই এই সমস্যা গুলো প্রকট করলেও দমাতে পারেননি তাকে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝুকিপূর্ণ অভিযান পরিচালনা করে চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্য উদঘাটনে দিবারাত্রি এক করে ছুটে চলেছেন। কখনো ক্লান্ত হন কিনা? জিজ্ঞেস করলে হাসি মুখে জবাব দেন “গতিই জীবন, যতদিন বেঁচে আছি মানুষের জন্য কাজ করে যেতে চাই”।

সততাও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে পুরুষ সহকর্মীদের সাথে দক্ষতা, সমতা রেখে গোপালগঞ্জ জেলার মত গুরুত্বপূর্ণ জেলায় ভিভিআইপি, ভিআইপিগণের প্রটোকল ডিউটি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা প্রদানের কাজে নিয়োজিত থেকে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছেন। চ্যালেঞ্জিং পেশায় অংশগ্রহণ করে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করেছেন বহুলাংশে।

আয়েশা সিদ্দিকা, বিপিএম, পিপিএম একজন নির্ভীক মানবিক পুলিশ অফিসার, বাংলাদেশ পুলিশের গর্ব তিনি। সৎ, পরিশ্রমী ও নিষ্ঠার সাথে দেশের একজন সেবক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। কখনোই কুসুমাস্তীর্ন ছিলো না এই মহীয়সী নারীর পথচলা। বাঁধা এসেছে বারংবার তবে অদম্য মনোবলে জয় করেছেন সকল বাঁধার দেয়াল। স্বপ্নবাজ এই নারী। মামলার তদন্ত, ক্লুলেজ মামলার রহস্য উদঘাটন, আসামি গ্রেপ্তার সহ বীরত্ব ও সাহসীকতাপূর্ণ কাজের জন্য কাজের স্বীকৃতিসূরূপ ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক (পিপিএম সেবা) ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম সেবা) অর্জন করেছেন। তার সাফল্যের পালকে যুক্ত আছে একাধিক আইজিপি ব্যাচ সহ শান্তিরক্ষী ম্যাডেল ও এক্সসেপশনাল লিডারশীপ এ্যাওয়ার্ড। 

এই নারী পুলিশ কর্মকর্তার সার্বিক দিক নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে খুন, ডাকাতি, ধর্ষন, চুরি, সংঘবদ্ধ অপরাধ, মানবপাচার সহ বিভিন্ন চ্যাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর মামলার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের আদালতে সোপর্দ করা হয়। এছাড়া মূলতবী থাকা অমীমাংসিত অনেক মামলার দ্রুত ও সুষ্ঠ নিস্পত্তিতে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। আলাপচারিতার কোন একফাকে হাসি মুখে আবারো বললেন কর্মক্ষেত্রে, পেশাগত দায়িত্বকে সর্বোচ্চ সম্মান ও ভালোবাসার জায়গায় অধিষ্ঠিত রেখেছি। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেশার উৎকর্ষতা বাড়াতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তিনি আরো বলেন কাজের স্বীকৃতি থাকুক বা না থাকুক কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আরো অনেক দূর যেতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সহকর্মীদের সহযোগীতায় বহুদূর এগিয়ে যেতে চান তিনি। পুত্র সন্তানহীন পরিবারের নিরাপত্তার ও নির্ভরতার অবলম্বন হয়ে বাবা-মার  স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন এই স্বপ্নবাজ নারী। পুলিশের পেশায় যোগদানের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থেকে পার করেছেন দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে অসহায় নারীদের সহায় হয়েছেন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সেবা প্রদানের মাধ্যমে। অসহায় নিপীড়িত নারী যে কথা পুরুষের কাছে নিঃসংকোচে বলতে পারেন না তারাও অনেক নির্ভরতায় ছুটে গিয়েছেন বার বার তার কাছে।

মানবিক এই পুলিশ কর্মকর্তা বিশ্বব্যাপী চলমান মহামারি করোনা ভাইরাস(কোভিড-১৯) এর সংক্রমন হতে গোপালগঞ্জ বাসিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে জেলার আপারময় জনসাধারনকে সচেতন করার নিমিত্তে সরকারি বিভিন্ন আদেশ উপদেশ প্রচারের মাধ্যমে তাদের দৌড় গোড়ায় পৌছানো সহ করোনা সুরক্ষা সামগ্রী (মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার) ইত্যাদি বিতরণ করেন। জেলার প্রতিটি পুলিশ ইউনিটে গমন করতঃ সেখানে কর্মরত পুলিশ সদস্যকে করোনাকালীন প্রয়োজনীয় ব্রিফিং ও করোনা সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান করেন। আক্রান্ত পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসা সেবা ও নিরাপদ আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করণ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যাবতীয় সহায়তা করা এবং এ জেলার দুঃস্থ ও অসহায় পরিবারের মাঝে জেলা পুলিশের উদ্যোগে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন।

এই কর্মকর্তা মনে করেন এককভাবে কোন কাজই সফলভাবে করা সম্ভব নয়। এখানে টিম ওয়ার্ক অত্যন্ত জরুরী। তার দুই বছরের অধিককাল সময়ে গোপালগঞ্জে প্রতিটি ইভেন্টে সকল কৃতিত্ব বারংবার ভাগ করে নিয়েছেন (টিম গোপালগঞ্জ) এর প্রতিটি সদস্যর সাথে। তিনি বলেন মুক্তারমালার একটি মুক্তাও যদি সঠিক বাঁধনে না বাধা পড়ে তবে যত দামি মুক্তাই হোক মালা গাঁথা সম্ভব নয়। তার জীবনে পথ চলার প্রতিটি ধাপে বার বার উচ্চারিত হয়েছে তার স্বপ্ন বুননের কারিগর বাবা মায়ের কথা। আরো উচ্চারিত হয়েছে তার পথচলার সারথী তার স্বামীর কথা। তার একমাত্র কন্যা তার সাফল্যের ভাগীদার। তিনি বলেন, পরিবারের সহযোগীতা না পেলে কখনোই সংসার আর কর্মক্ষেত্র দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হতো না।

কর্মক্ষেত্রে বারংবার স্বীকৃতির বিষয়ে জানতে চাইলে সেই হাস্যোজ্জল মুখে আবার হেসে উঠে বলেন, পুরুস্কার প্রাপ্তির অনুভূতি নিঃসন্দেহে মধুর। স্বীকৃতি সর্বদা এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দেয়। তিনি বলেন মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে পরিবারের ভূমিকা মুখ্য। স্বপ্নের বীজ বুনতে হবে পরিবার থেকেই। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে, তবেই সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মেয়েরাও আকাশ ছোঁবে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার নেতৃত্বে আছে তার সুযোগ্যতনয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা, এমপি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেল। মহিয়সী এক নারী। সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ক্রমান্বয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে পৌছানোর রুপ রেখা প্রণয়ন করেছেন। সেই নারী নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। এই নারী পুলিশ কর্মকর্তা বার বার বলেছেন বাংলার নারীরা অনেক বেশি পরিশ্রমী ও সামর্থবান। তাদের ভেতরে লুকাইতো প্রতিভার উন্মেষ ঘটাতে পারলেই ঘটবে এক মহা বিস্ফোরণ। নারীদের পিছিয়ে থাকার কোন কারণই নেই। এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, স্পীকার একজন নারী, বিরোধী দলীয় নেতা একজন নারী, সংসদ উপনেতা একজন নারী, সর্বোপরি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন আছেন যোগ্যতা সম্পন্ন একাধিক নারী। যারা তাদের যোগ্যতায় কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন সেই সকল নারীদের প্রতি নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তিনি।

পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে আপনি সফল হলেও গৃহীনি বা মা হিসেবে আপনার সাফল্য কতখানি, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অবশ্যই দুটোসত্তার রয়েছে আলাদা স্বতন্ত্রতা। গৃহিণী ও মা হিসেবে আয়েশা সিদ্দিকা একধরনের আর পুলিশের পোশাক পড়া আয়েশা সিদ্দিকা অন্য একরকম। স্বতন্ত্রতা তো থাকবেই। তবুও পরিবারকে উপেক্ষা করে নয়, সমাজকে ভালো রাখার পাশাপাশি নিজের পরিবারকে ভালো রাখাও পবিত্র দায়িত্ব।

কেনো এলেন এই পেশায়? এই প্রশ্নের জবাবে হো হো করে হেসে বললেন, আমার বাবার পরিবারে আমরা শুধুই মেয়ে সন্তান। পুত্র সন্তানের অভাব ছিলো আমার মায়ের চোখে। তাই সকল সময় ভাবতেন মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তাদের দেখবে কে? কিভাবে কাটাবেন বাকি জীবন? এই সকল প্রশ্নই একদিন এই স্বপ্নবাজ মেয়ের চোখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ছিলো বাবা মার নির্ভরতার মাধ্যম হওয়ার। একই সাথে সমাজের অসহায় জনগনের সেবারব্রত নিয়ে ছিলেন তিনি। আর সেই থেকেই এই পেশায় চলে আসা। বাই চান্স নয়, বাই চয়েজ দিয়ে তিনি পুলিশে এসেছেন। তিনি বলেন, পরিবারের মেজ সন্তান হিসেবে শৈশব থেকেই লড়তে হয়েছে তাকে। আর এই লড়াই করতে করতে বুঝে গেছেন চলার পথ এত সহজ নয়। এ যেনো এক সমস্যা আর উত্তরণের পরীক্ষার হল। আর সে থেকে যখনই কোন সমস্যা সামনে এসেছে দৃঢ় চিত্তে, অসীম সাহসীকতায় এগিয়ে গেছেন। তিনি বলেন তার সাফল্যের টিম লিডার তার বাবা আর রেফারি তার স্বামী। ব্যক্তি জীবন আর কর্মজীবন দুইই পারস্পরিক বোঝা পড়ার সম্মিলন। পরিবার থেকে উৎসাহ নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে আসে কর্মক্ষেত্রে সফলতা। তাই পরিবারকে বাদ দিয়ে কর্মক্ষেত্র নয়।

নারী দিবসের প্রাক্কালে সকল সংগ্রামী নারীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, এসেছি অনেক দুর যেতে হবে বহুদুর। মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই আ-জীবন। নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। আর বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে পরিচিত করার প্রমিথিউস এর প্রতি আরো একবার গভীর শ্রদ্ধা। মহিয়সি এই নারী পুলিশ কর্মকর্তার জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা অভিনন্দন ও শুভ কামনা রইলো।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by