উপ-সম্পাদকীয়

বিজ্ঞানীদের অমীমাংসিত সীমানা দৌড়!

  প্রতিনিধি ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ , ৬:৪১:৫৭ প্রিন্ট সংস্করণ

বিজ্ঞানীদের অমীমাংসিত সীমানা দৌড়!

মো. খবির উদ্দিন :

রহস্যঘেরা এই মহাজগত। নিখুঁত কারুকার্যে সুশোভিত দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো এই মহাজগত। দৃষ্টিসীমার মধ্যে ও আড়ালে রয়েছে অবিশ্বাস্য নিদর্শন। রয়েছে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্রহাণুপুঞ্জ ও নিহারিকা। রয়েছে সুশোভিত আসমান, সাগর-মহাসাগর। রয়েছে হাজার কোটি মহাবিশ্ব নিয়ে এক মহাজগত। রয়েছে একের পর এক অজানা রহস্য। বিজ্ঞানী-জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ এ রহস্যের একাংশও ভেদ করতে পারেনি। বিজ্ঞানীরা যা আবিষ্কার করছেন তা অধিকাংশই নতুন করে আবিষ্কারক বিজ্ঞানীদের তথ্যানুযায়ী পূর্বের তথ্য অসম্পূর্ণ বলে প্রমাণিত। পরস্পর বিরোধী বক্তব্যেই বোঝা যায় বিজ্ঞানীগণ এ রহস্য আবিষ্কারের শেষ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। সত্যিকারের রহস্য যিনি এ মহাজগতকে সুশৃঙ্খলভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনিই জানেন। আমরা মানব সম্প্রদায় শুধু সীমিত জ্ঞানেরই অধিকারী।

প্রাচীনকালে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য নানাবিধ বিশ্বতত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া হত। পুরাতন গ্রিক দার্শনিকরাই প্রথম এই ধরনের তত্ত্বে গাণিতিক মডেলের সাহায্য নেন এবং পৃথিবীকেন্দ্রিক একটি মহাবিশ্বের ধারণা প্রণয়ন করেন। তাদের মডেলে পৃথিবীই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহ, সূর্য ও নক্ষত্রগুলো ঘুরছে। তারা ভেবেছিলেন আকাশের তারাগুলো আমাদের থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত নয়।

বেশ কয়েকজন জ্যোতির্বিদ পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করলেও যতদিন না চৌদ্দশো শতকে কোপের্নিকাস সৌরকেন্দ্রিক মহাবিশ্বকে যৌক্তিকভাবে তার বইয়ে উপস্থাপনা করলেন ততদিন পৃথিবীকেন্দ্রিক ধারণা মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসে ছিল। পরবর্তীকালে নিউটনের গতি ও মহাকর্ষ সংক্রান্ত গভীর ধারণা পর্যবেক্ষণের সাথে সৌরকেন্দ্রিক জগতের সামঞ্জস্য নির্ধারণ করে। ধীরে ধীরে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করেন সূর্যের মতই কোটি কোটি তারা দিয়ে একটি গ্যালাক্সি গঠিত। কয়েকশ বছর আগেও বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সমগ্র মহাবিশ্ব মানে শুধুমাত্র আমাদের এই ছায়াপথ গ্যালাক্সিটিই। ১৯২০‘র দশকে উন্নত দূরবীনের কল্যাণে জ্যোতির্বিদরা আবিষ্কার করলেন ছায়াপথের বাইরে অন্য গ্যালাক্সিগুলোর। সেই কোটি কোটি গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে ছায়াপথের মতই কোটি কোটি তারাদের অবস্থান। সমস্ত গ্যালাক্সি থেকে আগত আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণে বোঝা গেল সেই গ্যালাক্সিগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর সহজতম ব্যাখ্যা হল গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে স্থানের প্রসারণ হচ্ছে এবং প্রতিটি গ্যালাক্সিই অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা হল সুদূর অতীতে সমস্ত গ্যালাক্সিগুলো বা তাদের অন্তর্নিহিত সমস্ত পদার্থই একসাথে খুব ঘন অবস্থায় ছিল এবং কোন মহাবিস্ফোরণের ফলে বস্তুসমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিস্ফোরণের নাম দেওয়া হল বিগ ব্যাঙ (Big Bang)।

বিগ ব্যাঙ তথ্যে যারা বিশ্বাস করেন তারা বলেন যে, আদিম অবস্থায় পৃথিবী নিশ্চয় বর্তমানে যেমন চোখ ধাঁধানো মন কাড়ানো সুশোভিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তেমন ছিল না। তখন পৃথিবীতে শূন্যতা বা শূন্যলোক বিরাজ করত। বিজ্ঞানীগণ জীবজগত সম্বন্ধে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, শূন্যলোকের সঙ্গে সূর্যের একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সূর্য থেকেই যে পৃথিবী সৃষ্টি তা নয়। সূর্যই জীবজগতের প্রাণকেন্দ্র, জীবন প্রদীপ। সূর্য তাপ দেয় জীবন সঞ্চার করে সমগ্র জীবজগতে। এই সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় নয় কোটি ঊনত্রিশ লাখ মাইল দূরে অবস্থিত। এই বিরাট ব্যবধানের জন্য সূর্য বৃহদাকার হলেও পৃথিবী থেকে তা একটি ছোট্ট থালার মত দেখায়। পৃথিবীর তুলনায় সূর্য তের লাখ গুণ বড়। সূর্য একটি বিশাল অগ্নিপিন্ড, যার দেহে জ্বলন্ত বাষ্পীয়মন্ডলী কুন্ডলী পাকিয়ে অনুক্ষণ আবর্তের সৃষ্টি করে চলছে। জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড হলেও সৌভাগ্যবশত সূর্যের ছড়ান তাপ ও আলোর কৃপায় পৃথিবীর বুকে সকল জীবজন্তু ও গাছপালার জীবন ধারণ সম্ভবপর হয়েছে। সৌরজগতের মধ্যে একমাত্র পৃথিবীতে প্রাণের বসবাস, বংশবৃদ্ধি ও প্রাচুর্য দেখা যায়।

বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি পৃথিবী এই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় লেগেছে এক লাখ পঞ্চাশ হাজার বছর। পৃথিবীতে প্রাণীর উন্মেষ ঘটে প্রায় একশ কোটি বছর পূর্বে। তাদের ধারণা তিন-চার লাখ বছর পূর্বেও পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেনি। বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে ৩,৫০,০০০ ধরনের উদ্ভিদ এবং ১৫,০০,০০০ ধরনের প্রাণী জীবজন্তুরও অধিক পরিমাণে প্রজাতির অস্তিত্ব রয়েছে। এ সমস্ত জীবজগতের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যাবে একমাত্র জীবাশ্মে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, “জড় জগতের এই প্রাণবস্তুর সৃষ্টি একদিকে যেমন ছিল অপূর্ব তেমনি পৃথিবীর পানি, মাটি ও পাথর প্রভৃতি যাবতীয় প্রাণহীন পদার্থ থেকে তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ও অভিনব। এক অপরূপ প্রাণবস্তু প্রোটোপ্লাজম। স্পর্শকাতর এক পেলব বিন্দু। এই ক্ষুদ্র বিন্দুর মধ্যেই বিকশিত হয়েছে যেন এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য- যেন উদ্ভাসিত জীবনের এক অলৌকিক প্রকাশ। স্বতঃস্পন্দনশীল চিরচঞ্চল এই প্রোটোপ্লাজম বিন্দুই হল সকল প্রাণীর প্রাণকেন্দ্র- সকল জীবনধারার আদি উৎস।”

মানুষের আবির্ভাব বা জন্মকথা প্রসঙ্গে দুটি বিপরীতধর্মী মতবাদ প্রচলিত রয়েছে, প্রথমটি একটি অলৌকিক দৈবশক্তি, যা সৃষ্টিকর্তা বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের মালিক আল্লাহতায়ালার অলৌকিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ, দ্বিতীয়টি ডারউইনের সূত্র অনুযায়ী মানুষ তার পূর্ব পুরুষ মানব গোত্রীয় বানর থেকে আবির্ভাবের তথ্যটি সুধী মহলে তুলে ধরেন। ডারউইন ছিলেন বিবর্তনবাদী। তার বিবর্তনবাদী সূত্রটি আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সকল বিজ্ঞানী বিশেষজ্ঞদের পক্ষে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কুরআন শরীফ এবং বাইবেলে মানুষের জন্ম কাহিনী সম্বন্ধে যা বর্ণিত আছে তার বিপরীতে ডারউইনের সূত্রের চরম বিরোধিতা করেন উইলিয়াম ট্রেয়ূস, সি.এস.কো, আর. ব্রম. ই.ডি. কোপ, হান্ট মর্গান প্রমুখ বিশেষজ্ঞগণ। ব্রম ছাড়াও ডারউইনি মতবাদের বিরোধিতা করেন মার্কিন জীবাশ্ম বিশারদ ই.ডি কোপ, তিনি সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট সূত্রের উপর সন্দেহ পোষণ করেন। ব্রন নিজেকে বিবর্তনবাদী মনে করলেও ডারউইনের মতবাদকে সমর্থন করেননি। ডারউইনের বিবর্তনবাদী ধারণা মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এবং মহান আল্লাহর সৃষ্টির সেরাজীব মানব সম্প্রদায়ের জন্য অপমানকর।

সূর্য আমাদের নিকটবর্তী নক্ষত্র। সূর্য থেকে আলো আসতে ৮ মিনিট মত সময় লাগে, কাজেই সূর্যের দূরত্ব হচ্ছে আনুমানিক ৮ আলোক মিনিট। আমাদের সৌরজগতের আকার হচ্ছে ১০ আলোক ঘণ্টার মত। সূর্যের পরে আমাদের নিকটবর্তী তারা হচ্ছে ৪ আলোকবর্ষ দূরত্বে। মহাবিশ্বের যতটুকু অংশ আমরা দেখতে পাই, সেটা হলো সমগ্র মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আমরা জানি মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন (বা ১৪০০ কোটি) বছর। তাহলে, মহাবিশ্বের ভেতর দিয়ে আলো মাত্র ১৪ বিলিয়ন বছর চলাচলের সুযোগ পেয়েছে। অতএব, আমরা পৃথিবীতে বসে এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ যে দূরত্ব পর্যন্ত দেখতে পাই তা হল ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। এটা হচ্ছে দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সীমানা। মহাজগতের নয়।

আমাদের এ সৌরজগতটা কত বড় তা বুঝার জন্য কেউ যদি প্রতি বর্গকিলোমিটারে পাঁচ মিনিট সময় ব্যয় করে তাহলে আঠারোশ বছর লেগে যাবে। এই যে বিশাল পৃথিবী, যার গায়ে আমরা পিঁপড়ার মত হেঁটে বেড়াচ্ছি, তার থেকে তেরোশ গুণ বড় বৃহস্পতি গ্রহ। বৃহস্পতি যদি একটা ফুটবলের সমান হয় পৃথিবীটা তাহলে হবে একটা মটর দানার সমান। নেপচুনকে যদি আমরা সৌরজগতের দূরতম গ্রহ হিসেবে ধরি তাহলে সৌরজগতের আয়তন দাঁড়ায় একশ ষাট লক্ষ কোটি ঘনকিলোমিটার। সৌরজগতের এক প্রান্ত থেকে যদি কেউ রেলে বিরতিহীনভাবে ছুটে চলে তাহলে অন্য প্রান্তে পৌঁছতে তার সময় লাগবে দশ হাজার বছর।

সৌর পরিবারের সবচেয়ে কাছে রয়েছে উপগ্রহ চাঁদ। বৈজ্ঞানিক তথ্য মতে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব আনুমানিক ৩,৮৪,৪০৩ কি.মি। সবচেয়ে দূরের বাসিন্দা প্লুটো তার কক্ষ পরিক্রমায় প্রতিদিন পাড়ি দেয় পঁচিশ লক্ষ মাইল (পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বের দশ গুণ) পথ। এভাবে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে তার সময় লাগে দুইশ আটচল্লিশ বছর ছয় মাস। তার অর্থ কোন যানে চেপে ঘণ্টায় এক লাখ মাইল বেগে সৌরজগতকে প্রদক্ষিণ করে আসতে সময় লাগবে আড়াইশ বছর। আমরা যে গ্যালাক্সিতে বাস করি তার নাম মিল্কিওয়ে ছায়াপথ। আমরা রাতের আকাশে যে তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলতে দেখি তার সবগুলোই (শুক্র, বৃহস্পতি আর মঙ্গল গ্রহ বাদ দিয়ে) আসলে আমাদের সূর্যের মত একেকটি সূর্য। সেগুলো সেকেন্ডে লক্ষ কোটি টন হাইড্রোজেন, মিথেন বা অন্য কোন গ্যাস পুড়ে মহাশূন্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিপুল মাত্রার উত্তাপ। আমাদের এ গ্যালাক্সিতে সূর্যের মত নক্ষত্রের সংখ্যা চল্লিশ হাজার কোটি। এরা প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে। বিজ্ঞানী জিলস ও জেফরিজ এর মতানুসারে প্রায় দু’শ তিন’শ কোটি বছর পূর্বের কোন একসময়ে সৌরজগতের একটি বৃহদাকার তারকা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সূর্যের কাছে এসে পড়ে কিন্তু সংঘর্ষ না ঘটিয়ে পাশ কাটিয়ে আপন কক্ষপথে চলতে থাকে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিশ্বজগতের সকল বস্তু, গ্রহ, নক্ষত্র একে অপরকে নিজের দিকে অদৃশ্য শক্তি দ্বারা আকর্ষণ করছে। এই শক্তি হচ্ছে মহাকর্ষ শক্তি, যা আবিষ্কার করে নিউটন। তিনি বলেন, মধ্যাকর্ষণ শক্তির বলে তারকামণ্ডলে প্রত্যেক গ্রহ ও উপগ্রহ স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে শৃঙ্খলার সাথে আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করছে। এ বিষয়ে মহান রাব্বুল আলামীন সুরা ইয়াসিন এর আটত্রিশ থেকে চল্লিশ নং আয়াতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন “সূর্য তার নির্দিষ্ট অবস্থানে আবর্তন করে। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহ্র নিয়ন্ত্রণ। চন্দ্রের জন্য আমি বিভিন্ন মনযিল নির্ধারিত করেছি। অবশেষে সে পুরাতন খর্জুর শাখার অনুরূপ হয়ে যায়। সূর্য নাগাল পেতে পারে না চন্দ্রের এবং রাত্রি অগ্রে চলে না দিনের। প্রত্যেকেই আপন আপন কক্ষপথে সন্তরণ করে।”

এক বছরে আলো যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে। ছায়াপথ গ্যালাক্সির ব্যাস এক লক্ষ আলোকবর্ষ। কেউ যদি কোন অলৌকিক যানে চেপে সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল গতিতে অবিরাম ছুটতে পারে তাহলে গ্যালাক্সিটা আড়াআড়ি পাড়ি দিতে তার এক লক্ষ বছর সময় লাগবে। যেখানে আলো এক সেকেন্ডে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করবে সাড়ে সাতবার। চাঁদের আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে সময় লাগে দেড় সেকেন্ড। সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় লাগে সাড়ে আট মিনিট। সূর্য থেকে প্লুটোতে আলো পৌঁছতে সময় লাগে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। আর সূর্যের পরে আমাদের সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেন্টরি (অন্য নাম আলফা সেন্টরি) থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছতে লেগে যায় সোয়া চার বছর। পরিধি বরাবর মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে প্রদক্ষিণ করে আসতে আলোর সময় লাগবে তিন লাখ চৌদ্দ হাজার বছর। এ হিসেবে মিল্কিওয়ে প্রদক্ষিণ করে আসতে সমবেগে চলমান একটা রাইফেলের গুলির লাগবে আলোর তুলনায় তিন লক্ষ গুণ বেশি সময়- প্রায় সাড়ে নয় হাজার কোটি বছর।

সূর্যের অবস্থান গ্যালাক্সি কেন্দ্র থেকে ত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। প্রতি পঁচিশ কোটি বছরে সূর্য গ্যালাক্সির মধ্যে তার কক্ষপথে একবার ঘুরে আসে পুরো সৌরজগত সাথে নিয়ে। পৃথিবীটা প্রতি সেকেন্ডে সাড়ে আঠারো মাইল বেগে ছুটে এক বছরে সূর্যের চারদিকে তার কক্ষ পরিক্রমা শেষ করছে।

এতদিন ধারণা ছিল, মহাবিশ্বে আমাদের পর্যবেক্ষণিক সীমার মধ্যে একশ বিলিয়নের বেশি ছায়াপথ রয়েছে। কিন্তু এবার বিজ্ঞানীরা বলছেন, পর্যবেক্ষণিক মহাবিশ্বের সীমার মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্যালাক্সির সংখ্যা অন্তত দুই ট্রিলিয়ন। আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্যালাক্সির নাম এ্যান্ড্রোমিডা। যার অবস্থান ছায়াপথ থেকে তেইশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। এর আনুমানিক ব্যাস দুই লক্ষ বিশ হাজার আলোকবর্ষ, নক্ষত্রের সংখ্যা এক লাখ কোটি। আর দূরতম গ্যালাক্সিটি রয়েছে প্রায় চৌদ্দশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে পুঞ্জীভূত অবস্থায় থাকার একটা স্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ রকম পুঞ্জগুলোকে বলা হয় ক্লাস্টার। মিল্কিওয়ে যে আঞ্চলিক পুঞ্জের সদস্য সেখানে রয়েছে প্রায় কুড়িটি ছায়াপথ। এগুলোর গড় দূরত্ব প্রায় পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ। এই আঞ্চলিক পুঞ্জগুলো প্রান্তহীন মহাকাশে একেকটি নিঃসঙ্গ দ্বীপের মত। আবার এই ক্লাস্টারগুলো মিলে গঠন করেছে ‘সুপার ক্লাস্টার’ বা অতিগুচ্ছ। একেকটি সুপার ক্লাস্টারের ব্যাস হতে পারে তিন থেকে দশ কোটি আলোকবর্ষ। একটা ক্লাস্টারকে যদি আমরা একটা দ্বীপ বলি তাহলে সুপার ক্লাস্টারকে বলতে হয় দ্বীপমালা। এর একটি থেকে আরেকটিতে যেতে বিশাল শূন্যস্থান পাড়ি দিতে হবে। ক্লাস্টারের অন্তর্গত গ্যালাক্সিসমূহ এবং সুপার ক্লাস্টারের অন্তর্ভুক্ত ক্লাস্টারগুলো অবিশ্বাস্য গতিতে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে মিনিটে এদের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে হাজার কোটি বা লক্ষ কোটি ঘনকিলোমিটার।

কেউ যদি এক কোটি গুণ বিবর্ধন ক্ষমতাসম্পন্ন একটা দূরবীন ব্যবহার করে তবেই কেবল সে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিকে দেখতে পাবে, তাও অতি ক্ষুদ্র একটা আলোকবিন্দুর মত। হয়তো আমাদের জানা মহাবিশ্বের মত হাজার কোটি মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে পুরো মহাজগতজুড়ে। আমরা দৃশ্যমান মহাবিশ্ব যে গোলক তৈরি করেছি, তার ব্যাস ২৮ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। আসলে এই দৃশ্যমান গোলকের আকার আরও বেশি। কারণ, ১৪ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের বিগ ব্যাঙ সময়ের কোন কণাকে দেখার পরও তো মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হতে থেকেছে। ফলে, সেই কণা এখন ৪৬ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। ফলে, দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস দাঁড়াচ্ছে ৯২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। আর প্রকৃত মহাবিশ্বের ব্যাস অজানাই রয়ে গেছে। হয়তো চিরকাল অজানাই থাকবে। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের যে আয়তন হিসাব করেছেন তা বস্তুতঃ আমাদের কল্পনাশক্তিকে অকেজো করে দেয়।

মহাজগতের সীমানা আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের তথ্যে আমরা হতচকিত। একের পর এক আবিষ্কারের নতুন নতুন তথ্য আমাদেরকে অস্থির করে তুলছে। আমাদের চিন্তাশক্তিকে অকেজো করে দিচ্ছে। সত্যিকারার্থে যিনি এ মহাজগত ও আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনিই ভালো জানেন রহস্যময় মহাজগতের পরিধি কতটুকু। সৃষ্টির রহস্য আমাদের এ সীমিত জ্ঞানের মাধ্যমে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবানদের ধারণা মতে বিজ্ঞানীদের চিন্তা ও চেষ্টা সীমার বাইরে এ মহাজগত সীমার রহস্য। এ রহস্যময় মহাজগতের পরিধি এবং সৃষ্টির নান্দনিকতা, নৈপুণ্যতা, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে স্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় এবং বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা বেড়ে যায়। কেননা এ সৃষ্টির পরতে পরতে রয়েছে তাঁর অসীম কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন।

লেখক : কলামিস্ট
Email: [email protected]
০১৭১১-২৭৩২৮০

Powered by