বাংলাদেশ

রাজস্ব বোর্ডের গোপন তথ্য ভিয়েতনামের হাতে!

  প্রতিনিধি ২৪ আগস্ট ২০২০ , ১১:৩৬:৫১ প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য ভাণ্ডার উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছিল ভিয়েতনামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। ২০১৮ সালে সে কাজ শেষ হলেও এখনও তার পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি।

ফলে বোর্ডের সব ধরনের গোপন তথ্য ভাণ্ডারে এখনও প্রবেশ করতে পারে ভিয়েতনামের প্রতিষ্ঠানটি।
সরকারের প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বলছে, আয়কর সংক্রান্ত করদাতার তথ্য রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং গোপনীয় তথ্য। আইন দ্বারা এসব তথ্যের গোপনীয়তার সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রকল্পের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এ কথাই বলেছে আইএমইডি। প্রতিবেদনটি এরইমধ্যে রাজস্ব বোর্ডে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, কর বিভাগকে পূর্ণাঙ্গ, স্বয়ংসম্পূর্ণ, আধুনিক, শক্তিশালী, জবাবদিতিমূলক ও প্রযুক্তিনির্ভর বিভাগ হিসেবে গড়ে তুলতে ‘স্ট্রেনদেনিং গভর্নেন্স ম্যানেজমেন্ট প্রজেক্ট’ (এসজিএমপি) বাস্তবায়ন করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শেষ হলেও ভিয়েতনামভিত্তিক আইটি প্রতিষ্ঠান এফপিটি ইনফরমেশন সিস্টেম কর্পোরেশন সম্পূর্ণ সিস্টেমটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে বুঝিয়ে দেয়নি। সিস্টেমটি পূর্ণাঙ্গ হস্তান্তরের আগেই সম্পূর্ণ বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ভিয়েতনামভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫১ কোটি টাকায় সফটওয়্যার সরবরাহ করে।

আইএমইডির এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পের ১১ ঝুঁকি ও ২৯টি দুর্বল দিক চিহ্নিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকল্পের তথ্য এখনও ভিয়েতনামের আইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে। এছাড়া সফটওয়্যারের দুর্বলতার কারণে এর অপব্যবহারের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য হারে রাজস্ব হ্রাসের কারণ হতে পারে।

তবে ভিয়েতনামের আইটি কোম্পানির হাতে তথ্য ভাণ্ডারের প্রবেশাধিকার রয়েছে বলে আইএমইডি যে দাবি করেছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে এনবিআর।

এনবিআর সদস্য (ট্যাক্স ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সার্ভিস) ও প্রকল্পের পরিচালক হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ  বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের পরই ভিয়েতনামের আইটি কোম্পানি আমাদের পাসওয়ার্ড বুঝিয়ে দিয়েছে। আইএমইডির দাবি ঠিক নয়। আমাদের নথির মধ্যে কেউ ঢুকতে পারবে না। ভিয়েতনামের আইটি কোম্পানি আমাদের শুধু সিস্টেম শিখিয়েছে। আমরা আইএমইডির প্রতিবেদন ঠিক করতে বলেছি, তারপরও তারা ঠিক করেনি।

আইএমইডি জানায়, সিস্টেম সম্পর্কে ১ হাজার ৮০০ আয়কর কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এনবিআর কর্মকর্তাদের খুব সীমিত টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের বাইট্যাক্স সিস্টেমের রূপরেখা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা নেই, এ কারণে সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কেনা হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর আংশিক কাজ করেছে। বর্তমানে বাস্তবায়িত অনলাইন সফটওয়্যারটির মাধ্যমে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে করদাতাদের রিটার্ন আপলোড করা সম্ভব হচ্ছে। সকল ক্যাটাগরির করদাতার রিটার্ন আপলোড সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আধুনিক ডাটা ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে উৎসে কর এবং অগ্রিম করা প্রদানের সুযোগ অনলাইন সফটওয়্যারটিতে রাখা হয়নি।

৭৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়ে জুলাই ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১৩ সালে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৭৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে ডিসেম্বর ২০১৫ সালে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই তিনবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৫৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় করে জুন ২০১৮ সালে শেষ করে এনবিআর।

সবশেষ কর বছরে কাগজে রিটার্ন দাখিলকৃত করদাতার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ কিন্তু অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করেছে মাত্র পাঁচ হাজার করদাতা। বর্তমানে অনলাইনে কর প্রদান সিস্টেমটি করদাতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন অনলাইনে আপলোড করা হচ্ছে।

প্রকল্পের ২৯টি দুর্বল দিকের গুরুত্বপূর্ণগুলো হচ্ছে- নভেম্বর ২০১৬ সালে অনলাইনে কর রিটার্ন দাখিল শুরু করা হলেও অনলাইন প্রক্রিয়াটি করদাতাদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়িত কর রিটার্ন দাখিল প্রক্রিয়াতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার ফলে কর প্রদানকরীরা অনলাইনে কর দাখিলে উৎসাহিত হচ্ছেন না। মোট করদাতার শূন্য দশমিক ১৩ শতাংশ অনলাইনে কর রিটার্ন দাখিল করছেন।

প্রকল্পটি ২০১৮ সালে শেষ হলেও ভিয়েতনামভিত্তিক আইটি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ বাইট্যাক্স সিস্টেমটি এনবিআরকে বুঝিয়ে দেয়নি। করদাতাদের অনলাইন ট্যাক্স হিসাব প্রস্তুত সম্পর্কে অবগত করা, করদাতারা সিস্টেমটি কিভাবে ব্যবহার করবে তা শেখানো, গ্রহকের বিশ্বাস এবং আস্থা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। প্রকল্পটিতে রিয়েল টাইমে কর পরিশোধের সুযোগ না থাকায় তা বাস্তবায়নের পরেও ঘরে বসেই করদাতারা সহজে কর পরিশোধ করতে পারছেন না।

এ প্রকল্পের ১১টি ঝুঁকির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, দীর্ঘ মেয়াদী টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ না দেওয়ার ফলে সিস্টেম পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। সফটওয়্যার ডেভেলপার কোম্পানির সাথে সার্ভিস এগ্রিমেন্ট ২০১৯ সালে শেষ হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে অনলাইন কার্যক্রমটি কিভাবে চলবে এবং কোন সমস্যা হলে সমাধানে তাদের কি ভূমিকা থাকবে এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। সার্ভারের স্পেস পূর্ণ হয়ে গেলে যে কোনো সময় সার্ভার ডাউন হয়ে যেতে পারে। এতে করদাতার কর রিটার্ন দাখিলের তথ্য বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে আইএমইডি।

আরও খবর

Sponsered content

Powered by